বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে অস্থিরতা চরমে। কিছু সিনিয়র ফুটবলার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে) স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন— “হয় কোচ, নয়তো আমরা”। তাদের দাবি, ইংলিশ কোচ পিটার বাটলারের অধীনে তারা আর খেলতে চান না।
বৃহস্পতিবার সাবিনা খাতুন, সানজিদা আক্তার, শামসুন্নাহার, ঋতুপর্ণা, মাসুরা ও মনিকার নেতৃত্বে ১৮ জন ফুটবলার সংবাদ সম্মেলন করে কোচের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। তারা দাবি করেন, কোচ তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার করছেন এবং মানসিকভাবে হয়রানি করছেন। তবে ফুটবল বিশ্লেষকদের মতে, মূল সমস্যা ১৮ জনকে নিয়ে নয়, বরং কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড়কে ঘিরেই এই বিদ্রোহ।
৫৮ বছর বয়সী ইংলিশ কোচ পিটার বাটলার ২০২৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ নারী দলের দায়িত্ব নেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের এলিট ফুটবল একাডেমির কোচ ছিলেন। ব্রিটিশ প্রিমিয়ার লিগ খেলা এই কোচ লাইবেরিয়া ও বোতসোয়ানার জাতীয় দলেও কাজ করেছেন।
তার কোচিংয়ে ২০২৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ নারী দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল। তবে তখন থেকেই কিছু সিনিয়র ফুটবলারের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। বিশেষ করে দলে নতুন খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়া এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার কারণে কিছু সিনিয়র ফুটবলার অসন্তুষ্ট ছিলেন।
ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্রোহের মূল কারণ কোচের কৌশলগত পরিবর্তন ও নতুন খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়া। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় দলে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখা কয়েকজন সিনিয়র ফুটবলার—বিশেষ করে সাবিনা খাতুন, সানজিদা আক্তার ও ঋতুপর্ণা চাকমা—এই পরিবর্তনে স্বস্তিতে ছিলেন না।
“সমস্যা ১৮ জনকে নিয়ে নয়, বরং ৩-৪ জন সিনিয়র ফুটবলারের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ হয়েছে। তারা কোচের শৃঙ্খলা ও নতুন খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়ার নীতিতে অসন্তুষ্ট ছিলেন।”
পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পথে বাধা সিন্ডিকেট?
পিটার বাটলার ২০২৪ সালের মার্চ থেকে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার লক্ষ্য ছিল দলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, তরুণদের সুযোগ দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক মানের পেশাদারিত্ব তৈরি করা। কিন্তু তার এই উদ্যোগে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সিন্ডিকেট সংস্কৃতি। ফুটবল বিশ্বে আধুনিক যুগে শৃঙ্খলা ও কঠোর পেশাদারিত্ব ছাড়া সাফল্য পাওয়া অসম্ভব। ব্রাজিল, জার্মানি, ইংল্যান্ডসহ বিশ্ব ফুটবলের শীর্ষ দলগুলোতে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতেই দলে জায়গা দেওয়া হয়। সেখানে সিনিয়র-জুনিয়রের নামে দলীয় বিভাজন সৃষ্টি করা হয় না।
বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবল এরই মধ্যে ভুগছে সিন্ডিকেটের কারণে। ২০০৬ সালে ব্রাজিলিয়ান কোচ ডিডো জাতীয় ফুটবল দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি দলের ভেতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং ভবিষ্যতের জন্য তরুণদের সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিনিয়র খেলোয়াড়দের একটি গ্রুপ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তাদের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে হয় ডিডোকে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে নারী ফুটবলে, যেখানে কোচের কঠোর শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়েছে।
কোচের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নাকি ব্যক্তিগত স্বার্থ?
ফুটবলাররা অভিযোগ করেছেন, কোচ তাদের বডি শেমিং করেছেন, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেছেন এবং গালিগালাজ করেছেন। তবে এই অভিযোগের অনেক কিছুই বিতর্কিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পিটার বাটলার কিছু সিনিয়র ফুটবলারের ফিটনেস নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, যা বিশ্ব ফুটবলে স্বাভাবিক বিষয়। তবে সেটাকেই ‘বডি শেমিং’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, দলে গ্রুপিং ও সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজনের বিষয়টিও বেশ আগে থেকেই ছিল, যা কোচ ঠিক করার চেষ্টা করেছেন।
সিন্ডিকেটের শিকার হয়ে বসুন্ধরা কিংস গত নারী লিগ থেকে নিজেদের সরাতে বাধ্য হয়েছিল। বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, এই সিন্ডিকেট নতুন নয়। গত নারী প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে সাবিনা খাতুন ও কিছু সিনিয়র ফুটবলারদের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরী করে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরী করে শেষ পর্যন্ত বসুন্ধরা কিংসকে লিগ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল। একাধিক অভিযোগের পরও বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। অনেকেই মনে করছেন, এবারও সেই একই গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষায় কোচকে অপসারণের জন্য লড়াই করছে।
বাফুফের অবস্থান: পিটার বাটলারই থাকছেন?
ফুটবল ফেডারেশন এখনো কোচের পক্ষেই রয়েছে। নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেছেন, “এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়, তবে বিদ্রোহের পেছনে কারা আছেন, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।”
ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ইমরুল হাসান বলেন, “বাংলাদেশের ফুটবল কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি নয়। পেশাদার ফুটবলে কোচের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, আর সেটাই মানা উচিত।”
বাংলাদেশের ফুটবলে পেশাদারিত্বের ভবিষ্যৎ :
যদি বাটলারকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে এটি হবে সিন্ডিকেটের আরেকটি বড় জয়। ভবিষ্যতে কোনো কোচ দলীয় শৃঙ্খলা আনতে চাইবেন না, কারণ তারা জানবেন যে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গেলে চাকরি টিকবে না। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের নারী ফুটবল।
বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি ইমরুল হাসান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, "বাংলাদেশের ফুটবল কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে জিম্মি নয়।" কিন্তু বাস্তবে কি তাই? যদি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশের ফুটবল আধুনিকতার পথে পা বাড়ানোর আগেই পিছিয়ে পড়বে আরও বহু বছর।
ফুটবল বিশ্লেষকরা বলছেন, সিন্ডিকেটের জয় মানে বাংলাদেশের নারী ফুটবলের অগ্রগতি থমকে যাওয়া। সিন্ডিকেটের হাতে নারী ফুটবলের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেওয়া মানে একধাপ পিছিয়ে যাওয়া। এখন সময় পেশাদারিত্বের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়ার, নয়তো বাংলাদেশের ফুটবল গর্তেই পড়ে থাকবে।
সূত্র নিউজ: https://protidinerbangla.net/sports/news/1027
এসআর
মন্তব্য করুন: