বাংলাদেশ-ভুটান প্রীতিম্যাচকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কনফারেন্স রুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ও ম্যাচ কাভারেজে যে চরম বিশৃঙ্খলা ও অপেশাদার আচরণের চিত্র ফুটে উঠেছে, তা নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়—বরং দেশের ফুটবল প্রশাসনের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থা, অদক্ষতা ও নেতৃত্বের ঘাটতির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের উপচে পড়া ভীড় দেখা যায়। দেশের প্রথম সারির অনেক অভিজ্ঞ ক্রীড়া সাংবাদিক ফ্লোরে বসে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে বা কোনে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ একদিকে যেমন ফুটবলের প্রতি গণমানুষের আগ্রহের চিত্র তুলে ধরে, তেমনি অন্যদিকে ফুটবল কাভারেজের পেশাদার ঐতিহ্য ও সাংবাদিকদের প্রতি অবজ্ঞার উদাহরণও বটে।
এই অচলাবস্থার প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মিডিয়া ইউনিটের চরম ব্যর্থতা, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বাফুফের মিডিয়া ম্যানেজার। অথচ একজন মিডিয়া ম্যানেজারের দায়িত্ব কেবল প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো নয়; সাংবাদিকদের তালিকা তৈরি, স্থান নির্ধারণ, বসার ব্যবস্থা, প্রশ্নোত্তর পর্ব, প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণসহ পুরো সম্মেলন ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ও পেশাদার ভূমিকা রাখা জরুরি। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল এর ঠিক উল্টো।
মিডিয়া ম্যানেজার সাংবাদিকদের প্রবেশে কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। যাঁরা বছরের পর বছর মাঠের ঘাম ঝরিয়ে দেশের ফুটবল কাভার করছেন, তাঁদের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করতেও ব্যর্থ হন। বরং দেখা যায়, কিছু নতুন, নাম-না-জানা ও বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চ্যানেল অ্যাক্রিডিটেশন পেয়ে গেছে—যাদের মিডিয়া পরিচয় ও ফুটবল কাভারেজের ধারাবাহিকতা নিয়েই সংশয় আছে।
অন্যদিকে, সুপরিচিত ক্রীড়া সাংবাদিক পরাগ আরমান, যিনি দেশের জনপ্রিয় চ্যানেল এটিএন বাংলা–এর প্রতিনিধিত্ব করেন, তাকেও অ্যাক্রিডিটেশন না দিয়ে ডে-পাস নিয়ে ম্যাচ কাভার করতে বাধ্য করা হয়েছে।
এই বিব্রতকর পরিস্থিতি নিয়ে পরাগ আরমান তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন-
এর চেয়েও হতাশাজনক চিত্র উঠে আসে ৩২ বছরের অভিজ্ঞ ক্রীড়া সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন–এর ক্ষেত্রে। যিনি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্রীড়াঙ্গনে কাজ করছেন, তাকেও অ্যাক্রিডিটেশন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে—যা ক্রীড়া সাংবাদিক সমাজের চোখে চরম অসম্মানের শামিল।
পরাগ আরমানের পোস্টে অভিজ্ঞ ক্রীড়া সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন ক্ষোভ নিয়ে লিখেছেন-
এর বাইরে আরও একটি গভীর ক্ষোভের জায়গা তৈরি হয়েছে—মিডিয়া বক্সে অযোগ্য ও অসাংবাদিক ব্যক্তিদের প্রবেশ।
যেখানে দেশের অভিজ্ঞ, প্রতিষ্ঠিত ও নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সাংবাদিকরা মিডিয়া বক্সে ঢোকার অনুমতি পান না, সেখানে বিভিন্ন সুপারিশপ্রাপ্ত, পরিচিত-ভিত্তিক কিংবা কেবলমাত্র কিছু মিডিয়া পরিচয়ধারী (যাঁরা প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিক নন) মানুষ মিডিয়া বক্সে বসে খেলা উপভোগ করছেন। এমন চিত্র দেখে অনেকে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।
একজন অভিজ্ঞ ক্রীড়া সাংবাদিক সরাসরি বলেন, “আমরা মাঠে হাফপ্যান্ট পরে ঢুকি না। আমাদের ঘাড়ে ঝুলে না পরিচিতির কার্ড। আমরা পরিচিতি পাই মাঠে কাজ করে, ঘাম ঝরিয়ে। অথচ আজ সেই ঘাম ভুলে মিডিয়া বক্সে বসছে যারা হয়তো মাঠ চিনেও না।”
সাংবাদিকদের এই অবমাননা ও অসাংবাদিকদের উপস্থিতি নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে অনেক সিনিয়র সাংবাদিক মাঠেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন—“যদি একটি প্রীতিম্যাচ ঘিরেই বাফুফে এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করে, তাহলে বড় কোনো আন্তর্জাতিক আসরে তারা কীভাবে মিডিয়া সামলাবে?”
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত অনেকেই বাফুফের প্রয়াত মিডিয়া ম্যানেজার অমিত ভাই–এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তাঁদের মতে, “অমিত ভাই বেঁচে থাকলে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। তিনি ছিলেন সাংবাদিকবান্ধব, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ। তাঁর নেতৃত্বে কোনো সংবাদ সম্মেলনে এমন বিশৃঙ্খলা হতে পারত না।"
আজকের এই বিশৃঙ্খলা যেন আরও একবার অমিত ভাইয়ের অনুপস্থিতিকে করুণভাবে স্মরণ করিয়ে দিল।
বর্তমানে ফুটবল অঙ্গনে নতুন এক আশাজাগানিয়া তরঙ্গ তৈরি হচ্ছে। তরুণদের আগ্রহ, সংবাদমাধ্যমের ভুমিকা এবং মাঠের উচ্ছ্বাস মিলিয়ে এক অনন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিতে হলে চাই শক্ত মিডিয়া কাঠামো, পেশাদার নেতৃত্ব এবং সাংবাদিকদের প্রতি যথাযথ সম্মান। তা না হলে এই তরঙ্গ ভেঙে পড়বে অদূর ভবিষ্যতেই।
সবচেয়ে করুণ বাস্তবতা হলো—যাঁরা বছরের পর বছর মাঠে বসে, গ্যালারির পেছন সারিতে দাঁড়িয়ে, অলিন্দে ঠায় অপেক্ষা করে দেশের ফুটবল সংবাদ সংগ্রহ করেছেন, তাঁদের অবস্থান দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। আর কেবল পরিচিতি ও ফেসবুক লাইভ নির্ভর কিছু তথাকথিত মিডিয়া পার্সন এই জায়গা দখল করে নিচ্ছেন। যা না শুধু সাংবাদিকতার জন্য বিপদ, বরং দেশের ফুটবলের পেশাদার ভিত্তিক উন্নয়নের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
সুতরাং এখনই প্রশ্ন তোলা জরুরি—বাফুফের মিডিয়া ইউনিট যদি একটি সাধারণ প্রীতিম্যাচ ঘিরে এত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, তাহলে তাদের ওপর ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক ইভেন্ট বা টুর্নামেন্টের দায়িত্ব অর্পণ কতটা যৌক্তিক?
যদি এখনই জবাবদিহি নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে মিডিয়া থাকবে, দর্শক থাকবে, কিন্তু ফুটবল কাভারেজের পেশাদার ভিত্তি ও মর্যাদা থাকবে না।
এসআর
মন্তব্য করুন: