বাংলাদেশের ক্রিকেটে একের পর এক হতাশাজনক পারফরম্যান্স একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ব্যাটিং লাইনআপের শক্তি এবং দক্ষতা নিয়ে গা-ছাড়া ভাব যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অগ্রগতি ম্লান হয়ে পড়েছে; ঘরোয়া মাঠে অথবা বিদেশে—ব্যাটিং ব্যর্থতা যেন একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ব্যাটাররা না থাকলে, দলের মানোন্নয়ন কীভাবে সম্ভব? এই প্রশ্ন এখন সর্বত্র।
বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের অসীম দুর্বলতা, অস্থিরতা এবং অকার্যকারিতা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমাদের ব্যর্থতা চরম পর্যায়ে। বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ যে ভঙ্গুর, তা কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে, যে কোনো দল যখন ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়, তখন সেটি শুধুমাত্র একক খেলোয়াড়দের দোষ বলে ঠেকানো যায় না—এটি একটি কাঠামোগত সমস্যা।
বর্তমান ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও বাংলাদেশের ব্যাটাররা প্রথম টেস্টে মাত্র ১৮০ ও ১২৬ রানে অলআউট হয়েছে, দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৬৪ রানে গুটিয়ে যায়। যেখানে বিশ্বের বড় টেস্ট ক্রিকেট দলের ব্যাটিং লাইনআপ পারফরম্যান্সের মাপকাঠি দাঁড়ায় ৩৫০ থেকে ৪০০ রানে, সেখানে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স আসলে একটি গভীর সংকটের চিত্র।
এমন ধারাবাহিক ব্যাটিং ব্যর্থতা নিয়ে কি দলের মনোবল টিকবে? দলের শীর্ষ ব্যাটারদের—যাদের মধ্যে মুমিনুল হক, লিটন দাস, মেহেদি মিরাজদের মতো অভিজ্ঞদের নাম উঠে আসে—কোনো একজনও গত তিন সিরিজে ধারাবিহকভাবে উল্লেখযোগ্য ইনিংস খেলতে পারেননি। প্রতিপক্ষের বোলিংয়ে তারা অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন। এতটা হতাশাজনক পারফরম্যান্স একটি গুরুতর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে খেলোয়াড়দের নিয়মিত ব্যর্থতার কারণে পুরো টেস্ট ক্রিকেটের ভাবমূর্তি বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
সদ্য দলে বাংলাদেশের ক্রিকেট জনপ্রিয় কোচ সালাহউদ্দিনের অন্তর্ভুক্তি এবং প্রত্যাশা যেভাবে ক্রিকেট প্রেমীরা দেখেছিল তা যেন আশাতে গুড়েবালিতে পরিণত হয়েছে। সাবেক ব্যাটিং কোচ হ্যাম্পের অধীনে ব্যাটিং ইউনিটে কোনো উন্নতি না হওয়ার পর, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে সালাহউদ্দিনকে নতুন ব্যাটিং কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সালাহউদ্দিনের অন্তর্ভুক্তি নতুন প্রত্যাশা তৈরি করলেও, তার নির্দেশনায় ব্যাটিংয়ে বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং অভিজ্ঞ ব্যাটারদের ব্যর্থতা এবং তরুণদের অসচেতন শট নির্বাচনের প্রবণতা পুরো ইউনিটের সামগ্রিক ব্যর্থতাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
দলের অভিজ্ঞ ব্যাটারদের ধারাবাহিক ব্যর্থতা দলকে চাপে ফেলেছে নিয়মিত। তামিম ইকবাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দীর্ঘদিন বাইরে থাকায় ওপেনিংয়ে আরও শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তার পরিবর্তে যারা খেলছেন, তারা স্থায়ীভাবে দায়িত্ব নিতে পারছেন না।
বাংলাদেশের বর্তমানে আশাজাগনোর স্থান হলো পেস এবং স্পিন বোলিং ইউনিটের, কিন্তু এই সিরিজে তারও দেখা মিলছে না সেভাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের পেস ইউনিটকে বিশ্বমানের ধরলেও এই সিরিজে যেন খেই হারিয়ে ফেলছে। ব্যাটিং ব্যর্থতার পাশাপাশি বাংলাদেশের বোলিং ইউনিটও গতি হারাচ্ছে। এই সিরিজে, পেস বোলিংয়ের প্রভাব কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। যেখানে প্রতিপক্ষের পেসাররা লাইন-লেংথ বজায় রেখে নিয়মিত উইকেট পেয়েছে, সেখানে বাংলাদেশি পেস বোলারদের কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল শূন্য—তাদের বোলিংয়ে ছিল না কোনো স্পষ্ট লক্ষ্য। এটি দলের বোলিং ইউনিটের একটি বড় দুর্বলতা, যা পরবর্তীতে দলের সমগ্র পারফরম্যান্সকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
স্পিনারদেরও যেটুকু ভূমিকা ছিল, তা ছিল আশা অনুযায়ী। ঘরের মাঠে স্পিনারদের সাফল্য কিছুটা এলেও তা ধারাবাহিক ছিল না, এবং বিদেশে সেই ধারাবাহিকতা লঙ্ঘিত হয় নিয়মিত।
বোর্ড কর্তাদের উদাসীনতা এবং পরিকল্পনার অভাব:
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব এবং উদাসীন মনোভাব দলের এই ব্যর্থতাকে আরও প্রকট করছে। টেস্ট ক্রিকেটে উন্নয়নের জন্য যেখানে ঘরোয়া লিগে মানসম্পন্ন পিচ তৈরি, টেস্ট ক্রিকেট অনুযায়ী ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষন, পেসারদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং খেলোয়াড়দের মানসিক দৃঢ়তা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, সেখানে এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
বিশ্বের অনেক ক্রিকেট বোর্ড যেখানে টেস্ট ক্রিকেটকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়, সেখানে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট যেন শুধুই একটি আনুষ্ঠানিকতার অংশ। উদাহরণস্বরূপ, ঘরোয়া লিগের পিচ মানসম্মত না হওয়ার কারণে ব্যাটাররা পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে তাদের দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে না।
বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ—এটি শুধু সাম্প্রতিক নয়, বরং বহু বছর ধরে চলমান একটি সমস্যা। ব্যাটিং ইউনিটের অস্থিরতা এবং বোলিংয়ের ধারাবাহিকতার অভাব, দুটি বিষয়ই এখন দলের জন্য জটিল চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে, আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বাংলাদেশের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
এসআর
মন্তব্য করুন: