বাংলাদেশের ক্রিকেটে ব্যাটিং পারফরম্যান্স একটি কালো অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে দেশের ব্যাটিং লাইনআপ ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে ক্রিকেটপ্রেমীদের হতাশ করেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সম্ভাবনাময় দল হিসেবে পরিচিতি পেলেও, তাদের ব্যাটিং ব্যর্থতা এবং দেউলিয়াত্ব নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার। ধারাবাহিকতার অভাব, দায়িত্বশীলতার সংকট, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশের ব্যাটিং যেন গভীর খাদে হারিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ব্যাটিংয়ের অধারাবাহিকতার এক অব্যাহত দুর্দশা এখন নিয়মিত। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং মানেই যেন এক বিশাল অধারাবাহিকতার চিত্র। ক্রিকেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে দলের টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি—সব ক্ষেত্রেই ব্যাটিংয়ের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে উঠেছে। বিগত কয়েকটি সিরিজে মাঠে বাংলাদেশের ব্যাটিং পারফরম্যান্স একের পর এক হতাশার জন্ম দিয়েছে, যা ক্রমশ একটি নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দলে এমন অস্থিরতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ের কারণে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই ফলাফল বাংলাদেশের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। কখনো দলীয় স্কোর বড় রান তাড়া করার পর্যায়ে থাকে না, আবার কখনো রান তোলার সময় ব্যাটসম্যানদের একের পর এক উইকেট পতন। যে দলের বোলাররা নিজেদের কাজ ঠিকভাবে করতে সক্ষম হন, তাদের ব্যাটিংই দলের মূল সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাটসম্যানদের শট নির্বাচন ও পরিকল্পনার অভাব চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মাঝে শট নির্বাচনের ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সিরিজে, বিশেষত অ্যান্টিগা টেস্টের মতো ম্যাচগুলোতে, তাদের শট নির্বাচন ছিল অসুস্থ এবং অকাল সময়ে উইকেট হারানোর কারণ। এমনকি অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে আশানুরূপ দায়িত্বশীলতা দেখা যায়নি।
টেস্ট ক্রিকেটে যদি লক্ষ্য তাড়া করার কথা বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের দুর্বলতা সেখানেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে চলমান সিরিজের মতো সিরিজগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কখনো ব্যাটিংয়ের যথাযথ পরিকল্পনা দেখাতে পারেনি। রেকর্ড গড়তে গিয়ে ৩৩৩ রানের মতো লক্ষ্য তাড়া করার চেষ্টায় ব্যাটসম্যানদের অবিচল থাকার দরকার ছিল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা উইকেট হারিয়েছে একের পর এক দায়িত্বহীন শটের মাধ্যমে।
ধসে যাওয়া ব্যাটিং পারফরম্যান্স ওয়ানডেতে চরম বিব্রতকর অবস্থান বাংলাদেশের ক্রিকেটে।ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ ধারাবাহিকভাবে তাদের ব্যর্থতার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং গড় মাত্র ৩১.৫২, যা শীর্ষ দলগুলোর তুলনায় হাস্যকর। ২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ৯ ম্যাচে মাত্র দুইবার ২৫০ রানের গণ্ডি পেরোতে পেরেছে। আফগানিস্তান এবং নেদারল্যান্ডসের মতো তুলনামূলক দুর্বল দলগুলোর বিপক্ষে মাত্র ১৫৬ এবং ১৪২ রানে অলআউট হওয়া দলের ব্যাটিং ব্যর্থতার চূড়ান্ত উদাহরণ।
লিটন দাস, সাকিব আল হাসান, এবং মুশফিকুর রহিমের মতো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানরা বিশ্বকাপে তাদের সেরা ফর্মে খেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। যেখানে লিটন গড়ে ৩৮.২২ এবং সাকিব ২৪.১১ গড়ে রান করেছেন, তা আন্তর্জাতিক মঞ্চে অনান্য দলের সাথে যদি মিলাতে হয় তাহলে বাংলাদেশের ব্যাটিং এর অবস্থা খুবই নাজুক।
টেস্টে ব্যর্থতার সীমাহীনতা যেন এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যপারে দাড়িয়েছে। টেস্ট ফরম্যাটে বাংলাদেশের ব্যাটিং পারফরম্যান্স আরও হতাশাজনক। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের টেস্ট ব্যাটিং গড় মাত্র ২৭.০১।
শুধুমাত্র পাকিস্তান সফর বাদ দিয়ে পরবর্তী বেশ কয়েকটি সিরিজে বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা ছিল চরম পর্যায়ে। বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা ক্রিকেটের জন্য আরেকটি কালো অধ্যায়। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা বড় কিংবা ছোট দলের বিপক্ষে রান করা তো দূরের কথা, নিজেরাই নিজেদের চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ের অভাব এবং পরিকল্পনার দুর্বলতা স্পষ্টতই বোঝা যায়।
বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ বর্তমানে এমন পর্যায়ে যা আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি প্রহসনের নাম। ধারাবাহিকতার অভাব, দায়িত্বশীলতার সংকট, এবং সঠিক পরিকল্পনার ঘাটতি বারবার দলকে নিচে নামাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একসময় সম্ভাবনাময় দল হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ এখন ব্যাটিং ব্যর্থতা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার।
বাংলাদেশের ধারাবাহিক ব্যাটিং ব্যর্থতার জন্য কোন ভাবেই ‘বিসিবি’ দায় এড়াতে পারে না। যেখানে সারা বিশ্বে বোর্ডগুলো যেখানে ক্রিকেটের উন্নয়ন নিয়ে নিরলস কাজ করছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা হতাশাজনক। তালেবান সরকারের অধীনে থাকা আফগানিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডেও এমন বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি। বাংলাদেশ কি পারবে নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে? দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সময় এসেছে এসব জোড়াতালি সংস্কৃতি বাদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল নিয়ে কাজ করার।
এভাবে ব্যাটিং ধসের এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে, খুব শিগগিরই বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাদের অবস্থান হারাবে।
এসআর
মন্তব্য করুন: