শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.): জ্ঞান, চিকিৎসা ও প্রশাসনে মুসলিম নারী নেতৃত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে বহু নারী জ্ঞানচর্চা, সমাজগঠন ও মানবসেবায় অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। সেই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.)— যিনি চিকিৎসা, শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে একাধিক ক্ষেত্রে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন।
বংশপরিচয় ও ব্যক্তিজীবন
শিফা (রা.) ছিলেন কুরায়শের এক সম্মানিত পরিবারের সন্তান। তার মূল নাম ছিল লাইলা; তবে চিকিৎসায় পারদর্শিতার কারণে তিনি “শিফা” উপাধি অর্জন করেন। তার স্বামী আবু হাতমা ইবনে হুযাইফা এবং দুই সন্তান সুলায়মান ও মাসরূক ছিলেন। হজরত ওমর (রা.)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল তাদের পরিবারে।
ইসলাম গ্রহণ ও নবীজির (সা.) ঘনিষ্ঠ সাহাবি
ইসলামের একেবারে সূচনালগ্নেই তিনি মুসলিম হন এবং মদিনায় হিজরতের প্রথম দিককার সাহাবিদের একজন ছিলেন। মসজিদে নববীর পাশেই ছিল তার বাসস্থান, যা তাকে নবীজি (সা.)-এর পরামর্শদাতা ও ঘনিষ্ঠ অনুগত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। হাদিসবিদ ইবনে হাজার তার প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা ও মর্যাদার বিশেষ প্রশংসা করেছেন।
সাক্ষরতা ও নারী শিক্ষায় পথিকৃৎ
জাহেলি যুগে নারীদের সাক্ষরতা ছিল অতি সীমিত। সেই সময় শিফা (রা.) ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন লেখাপড়া জানা নারীর অন্যতম। তিনি শুধু পড়তেই নয়, দক্ষতার সঙ্গে লিখতেও পারতেন।
তার প্রথম ছাত্রী ছিলেন হজরত হাফসা (রা.)— যিনি পরবর্তীতে কোরআনের সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিফা (রা.) তাঁর মাধ্যমে নারী শিক্ষার গুরুত্বকে আরও প্রসারিত করেন।
শিফা (রা.) বিশ্বাস করতেন— জ্ঞান অর্জন ও অন্যকে শিক্ষা দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে মহান সাদকা। তিনি মানুষের কাছে জ্ঞানকে সবার জন্য উন্মুক্ত করার কথা বলতেন।
চিকিৎসায় নারীদের অগ্রদূত
তৎকালীন আরব সমাজে চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। কিন্তু শিফা (রাঃ) ছিলেন দক্ষ নারী চিকিৎসক। একটি রোগ— যা আজকের দিনে র্যাশ বা ত্বকে ফোস্কা হিসেবে পরিচিত— তার চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন।
নবীজি (সা.) ব্যক্তিগতভাবে তাকে হাফসা (রা.)-কে এই চিকিৎসা শেখাতে নির্দেশ দেন, যা তার দক্ষতার প্রতি নবীজির আস্থাকে প্রকাশ করে। তিনি হলুদ ও ভিনেগারের মিশ্রণে একটি বিশেষ পেস্ট ব্যবহার করতেন, যা তখনকার সময়ে বেশ কার্যকর ও ব্যাপক পরিচিত ছিল।
বাজার ব্যবস্থাপনায় প্রথম নারী কর্মকর্তা
শিফা (রা.)-এর আরেকটি অসাধারণ অবদান ছিল রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন। খলিফা হজরত ওমর (রা.) তাকে মদিনার বাজার তদারকির দায়িত্ব দেন— যা তাকে ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক নারী কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
বাজারে প্রতারণা রোধ, ওজন-পরিমাপ ঠিক রাখা এবং ন্যায্য বাণিজ্য নিশ্চিতকরণে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে তার ন্যায়পরায়ণতা ও সততা বিশেষভাবে সমাদৃত ছিল।
অনুপ্রেরণার বার্তা
শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.)-এর জীবন প্রমাণ করে— সঠিক জ্ঞান, দৃঢ়তা ও নৈতিকতার মাধ্যমে যেকোনো নারী সমাজে নেতৃত্বদানকারী শক্তিতে পরিণত হতে পারেন। প্রথম যুগের মুসলিম নারীদের মাঝে শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রশাসনিক দক্ষতার সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্তগুলোর একটি হলো তার জীবন।
এসআর
মন্তব্য করুন: