news.protidinerbangla22@gmail.com বৃহঃস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৪ আশ্বিন ১৪৩১

অস্তিত্ব সংকটে আওয়ামী লীগ

মাসুদুল হাসান অলড্রিন

প্রকাশিত: ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৮:০৯ পিএম
আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৯:০৭ পিএম

আওয়ামী লীগের লোগো

গত ৫ আগষ্ট প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর অনেকটা বানের জলের মতো ভেসে গেছে আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড।

টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আসা দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতনের পর অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ছে। দলটির প্রধান শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃনমূলের নেতারাও লাপাত্তা।

দেশের মধ্যে কোথাও কারও দেখা মিলছে না। পতনের পর মাস হতে চলছে কোথাও কোনো কর্মসূচিও নেই। এমন পরিস্থিতিতে হত্যাসহ গুরুতর অপরাধে মামলার আসামি হয়ে কারাগারেও যেতে হয়েছে একাধিক প্রভাবশালী নেতাকে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা, পারলেও কবে নাগাদ দৃশ্যপটে আসবেন নেতাকর্মীরা তা অজানা।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ যাবৎ কালের সবচেয়ে নাজুক ও সংকটময় অবস্থায় পড়েছে টানা ৪ মেয়াদে দোর্দণ্ড প্রতাপে সরকার পরিচালনা করা আওয়ামী লীগ। তারা বলছেন, গত ৫ আগষ্ট প্রবল গণ আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর অনেকটা বানের জলের মতো ভেসে গেছে আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড।

আওয়ামী লীগের এমন পরিণতির জন্য লাগামহীন দুর্নীতি, দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের মূল্যায়ণ না করা, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভাষা বুঝতে না পারা, বিরোধী দল ও বিরোধী মতকে অবমূল্যায়ন করা, অপরিপক্কদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেয়া ও সবশেষ ছাত্র আন্দোলনকে গুরুত্ব না দেয়া।


তবে এমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে আওয়ামী লীগকে বেগ পেতে হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দলীয় সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে অনেক নেতাকর্মী সীমান্ত পার হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশের ভেতর পালিয়ে থাকা, দলটির কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী ঘরানার অবসরপ্রাপ্ত আমলা, বুদ্ধিজীবিসহ সবাই গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন।

এদিকে সরকার পতনের দশ দিনের মাথায় আওয়ামী লীগ ১৫ আগষ্ট পালন করতে পারেনি। সেদিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে দলটির নির্বাহী কমিটি, উপদেষ্টা পরিষদ এবং সাবেক মন্ত্রী, দলীয় সংসদ সদস্য, কারো উপস্থিতি ছিলো না। এমন কি কর্মীরাও আশপাশে ভিড়তে পারেনি। দলীয় হাই কমান্ডের আহ্বান করলেও নেতারা কেউ দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেন নি। এমনকি, ২১ আগষ্ট ‘গ্রেনেড হত্যাকান্ড স্বরণসভা’র দিনটিও চলে গেছে নিরবে নিভৃতে।


বিশ্লেষকরা বলছেন, দল ও সরকারে একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভয়ংকর দূনীতির অভিযোগ উঠলেও তা দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে এবং দুর্নীতিগ্রস্থ আমলাদের প্রতি শিথিলতা দেখানো হয়েছে। তারা বলছেন, শেয়ার বাজার কেলেংকারীতে যুক্ত বেক্সিমকো , এস আলম , সামিট, অরিয়ন ও সিকদার গ্রুপের মত বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে বিগত সরকারের নমনীয়তা ছিলো। নানা সময়ে রাঘব বোয়ালদের ছাড় দেওয়া হয়েছে।

শত শত কোটি টাকা পাচার করে, পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহম্মেদ, এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর , সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর, পিকে হালদার সহ এসব বৃহৎ ব্যক্তির নিরাপদ বিদেশ গমন ব্যাপক জনরোষ তৈরি হয় এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্রজনতার ভেতর বারুদের মত কাজ করে। এটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকে সফল করে তোলে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভাষা বুঝতে না পারাকেও দুষছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক মতামতকে উপেক্ষা করা। বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘ ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে চলমান ‘একপেশে’ রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কমবেশি উষ্মা প্রকাশ করেছে।

তারা বলছেন, ২০১৪ নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩টি নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ছিলো না। নির্বাচনগুলোতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ না থাকায় তা আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

এক পর্যািয়ে ভারত ও রাশিয়া ছাড়া শেখ হাসিনা বহিঃবিশ্বে বন্ধুহীন হয়ে পড়েন। এতে আন্তর্জাতিক জনসমর্থন হারাতে থাকে তার সরকার। এটি সুযোগটি অভুত্থান ঘটাতে সহায়তা করে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচন করার পর আওয়ামী লীগে মাত্রারিক্ত হাইব্রিড ও ভাড়াটে বুদ্ধিজীবি ভিড়তে শুরু করে।

আওয়ামী লীগের নাম ও লোগো ব্যবহার করে বিভিন্ন ভূইফোড় সংগঠন আওয়ামী লীগের ভেতর ঢুকতে শুরু করে। দলের নানা পর্যায়ে কেন্দ্রীয় নেতা এমপি মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে তাদের স্বাগত জানান, কাছে টেনে নেন।


এছাড়াও বিগত সরকার, আমলা ও পুলিশ বাহিনীকে অঘোষিত দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিলো বলে সচেতন মহলের অনেকে মনে করেন। জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের লোকদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধে মামলার করার জন্য সরকারের অনুমতি নেয়ার বিধান সংযোজন করা হয়।

বিষয়টি জনগনের ভেতর ক্রমান্বয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, এতে আমলারা অনেকে দুনীতি পরায়ন ও বেপোরোয়া হয়ে পড়েন।
অন্যদিকে ২০০৯ সালে জাতীয় কাউন্সিলসহ পরবর্তী সকল কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের দক্ষ ও অভিজ্ঞ সিনিয়র নেতারা দল ও সরকার থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। সংসদ দল ও কেবিনেটে, অদক্ষ ও আনকোড়া রাজনীতিকরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হতে শুরু করেন। বারবার বির্তকিতরা জায়গা করে নিয়েছে সংসদ ও মন্ত্রীসভায়।

সবশেষ জুলাই মাসের শুরুতে লাখ লাখ সাধারন ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কারের দাবীকে হালকাভাবে নিয়েছিলো সরকার। সরকারের কেবিনেট সদস্যরা, দায়িত্বশীলরা আন্দোলনকারী এসকল তরুণদের সাথে সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হন।

নানা এজেন্সী বল প্রয়োগ করা, শুরু করে। এবং এই আন্দোলনকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অপচেষ্টা হিসেবে গণমাধ্যমে বলেন। এবং সর্বশেষ তা দমন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশের গুলিতে একের পর এক লাশ পরে যাওয়ায় সারাদেশ অগ্নি গর্ভ হয়ে ওঠে। ছাত্র জনতা সরকারকে হঠানোর একদফা দাবী নিয়ে মাঠে নেমে আসে।

বিশেষ কওে গনমাধ্যমের ভিডিও ফুটেজে দৃশ্যমান, পুলিশের সরাসরি গুলিতে রংপুরের আবু সাঈদের মৃত্যর পর ফুঁসে উঠে গোটা দেশ। এক পর্যারয়ে সরকার প্রধানকে করুনভাবে বিদায় নিতে হয়েছে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের খ্যাতিমান অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ যদি ভিন্নমতকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিতো, তাহলে আজকে এই পরিনতি বরণ করতে হতো না।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের উথ্থান পতন আসবে। তবে এমন নয় এটি স্থায়ী হবে। পরিস্থিতির উত্তরন ঘটবে। আদর্শ ভিত্তিক দল কখনো নিঃশ্বেষ হয়না; সাংগঠনিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। তবে তারা ঘুরে দাড়াবে।

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর