বিস্ময়কর হলেও সত্য, আওয়ামী লীগের এক বছর আগেই জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের, যার প্রাথমিক নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এর এক বছর পর গঠন করা হয় আওয়ামী লীগ।
ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলন, স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্বাধীনতার আগে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অপরিসীম, কিন্তু স্বাধীনতার পর এ সংগঠনটি নানা বিতর্কের সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে ড. মোহাম্মদ হান্নান তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন যে দেশ বিভক্তির পর ছাত্রলীগ ব্যাপকভাবে লাভবান হয়। ভাষা আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
ড. হান্নান ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে যেভাবে দেখা হয়, তা তাদের সংগ্রামমুখর ইতিহাসকে পুরোপুরি উপস্থাপন করে না। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা, এবং মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ছয় দফার পক্ষে ছাত্রলীগ প্রথম জনসমর্থন গড়ে তোলে এবং ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তোলে।
ছাত্রলীগ ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান সহায়ক ছিল। ২ মার্চ ১৯৭১ সালে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিও শুরু করে। মুজিববাহিনীতেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অংশ নেয়।
স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের ভূমিকা বিতর্কিত হতে শুরু করে। লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৯৭১ সালের পর ছাত্রলীগের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের রূপ নেয়। এর ফলে সংগঠনটি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে এবং লড়াকু চরিত্র থেকে সরে যায়। গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষ করে ২০১৯ সালে সিলেটের এমসি কলেজে ধর্ষণ, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড, এবং বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, “অপকর্ম করবে, এমন ছাত্রলীগ চাই না।”
বিশ্লেষকদের মতে, ছাত্রলীগ তার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ক্যাম্পাসভিত্তিক একটি আওয়ামী লীগ সমর্থিত সংগঠনে পরিণত হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে সংগঠনটির অপকর্ম ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ বেড়েছে, যা ছাত্রলীগের ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামী চরিত্রকে ম্লান করেছে।
ছাত্রলীগ সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, খুন, লুটপাট এবং যৌন সহিংসতাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বারবার সমালোচিত হয়েছে। বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা জসিমউদ্দিন মানিকের বিরুদ্ধে ১০০ ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে, যা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিছিল করে এবং তাদের ওপর রড, লাঠি, হকিস্টিক ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়।
চলতি বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে নারীদের ওপর সহিংসতার অভিযোগও ওঠে, যা সংগঠনটির ওপর নতুন করে সমালোচনার ঝড় তোলে।
এসআর
মন্তব্য করুন: