কয়েক বছর ধরে আমরা লক্ষ্য করছি, দেশে যখনই কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটে, তখনই এক দল স্বাভাবিকভাবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও আরেক দল এর পক্ষে অবস্থান নেয়।
শুধু তাই নয়। শেষোক্তরা কেন ওই সহিংসতা বৈধ ছিল– সে বিষয়ে বয়ানও উৎপন্ন করে। অথচ যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রে সবারই কাছে সহিংসতা মাত্রই নিন্দনীয় হওয়ার কথা।
সম্ভবত তারই নিদর্শনস্বরূপ গত ১২ ডিসেম্বর শুক্রবার ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি যখন নৃশংসভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন, তখন অন্য সবাই এর নিন্দা জানিয়ে হাদির দ্রুত সুস্থতা কামনা করলেও কিছু মানুষ, বিশেষত সামাজিক মাধ্যমে বিকৃত উল্লাস প্রকাশ করেন।
শেষোক্তরা এমনকি গুলিবর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হন।
হাদির ওপর হামলার সঙ্গে তুলনীয় না হলেও এ প্রসঙ্গে আগের দিন ১১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের লাউঞ্জে পাঁচ শিক্ষককে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক জুবায়েরের হেনস্তা করার বিষয়টিও উল্লেখ করা যায়।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, জুবায়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সিঁড়িতে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক জামালউদ্দিনকে শারীরিকভাবে আঘাত করছেন।
তাঁকে কাপড় পেঁচিয়ে আটকানোরও চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া জুবায়েরকে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আজমল হোসেন ভূঁইয়াকে নিয়েও টানাহেঁচড়া করতে দেখা গেছে। যথারীতি ফেসবুকে এ ঘটনারও পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হুমকি-ধমকি দেওয়া, কটূক্তি করা ইত্যাদি অভিযোগ দায়ের হয়েছে, যেখানে অধ্যাপক জামালউদ্দিনের নামও আছে।
যতদূর জানি, ইতোমধ্যে ১৫ মাস চলে গেলেও উত্থাপিত অভিযোগগুলো এখনও তদন্তাধীন। কিন্তু সে প্রক্রিয়ার মধ্যেই ওই একই অভিযোগ তুলে তাঁকে কি শাস্তি দেওয়া যায়? আর এর দায়িত্বই-বা ওই ডাকসু প্রতিনিধিকে কে দিল? হতাশাজনক হলো, গণতন্ত্রের পীঠস্থান বলে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব বিষয়ে একেবারে চুপ।
তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, ডাকসুই চালাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন?
এর আগেও ডাকসু নেতারা ক্যাম্পাসে গায়ে মানে না আপনি মোড়ল সেজে হকার উচ্ছেদ, এমনকি হকারদের নিপীড়ন পর্যন্ত করেছেন। আর প্রশাসন তাদের এসব এক প্রকার মববাজি জেনেও কিছু বলেনি।
এসব দেখে যদি বলা হয়, আগের প্রশাসনগুলোর মতোই সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত এক পক্ষকে সঙ্গে নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চলছে, তা হলে ভুল হবে না।
কিন্তু এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে কম-বেশি অনেক শিক্ষকের মধ্যে। কারণ তারা মনে করছেন, এ অবস্থা চললে যে কোনো অজুহাতে যে কেউই অপছন্দের শিক্ষককে হেনস্তা করতে পারে।
শিক্ষকরা এখন শিক্ষার্থীদেরও ভয় পাচ্ছেন। বলছেন, কাকে পড়াবেন?
এই যে ১৬ মাস ধরে বিভিন্ন জায়গায় মব সন্ত্রাস ঘটেই চলেছে; অন্যদিকে সরকারের কেউ কেউ এটা ‘জনরোষ’, ‘প্রেশার গ্রুপ’ ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ ইত্যাদি বলে অপরাধীদের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন, তার ফল কি ভালো হয়েছে? আজকে যে পুলিশ, এমনকি সেনাসদস্যরা গুরুতর মব সন্ত্রাস দেখেও পাশ কাটিয়ে যান, তা কি এমনি এমনি হয়েছে? এর ফলে যে ভয়ের অপসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে, তা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও মুক্ত নন।
অস্বীকার করা যাবে না, মূলত এ প্রেক্ষাপটেই সহিংসতা উস্কে দেওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও নির্বাচনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা শঙ্কা দূর করতে সরকার নজিরবিহীনভাবে তাদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরকারের এ সিদ্ধান্তে এটাও মনে করার অবকাশ তৈরি হয়, নির্বাচনের সময় সহিংসতা হবেই– এটি ধরে নিয়েই আমরা এগোই। কার ওপর আঘাত কাকে বা কোন পক্ষকে লাভবান করছে বা করবে, তার হিসাবনিকাশ শুরু করি।
না হলে গত ১৫ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি প্রশ্নে প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি কেন বললেন, ‘মাঝেমধ্যে দুই-একটা খুনখারাবি হয়। এই যে হাদির একটা ঘটনা হয়েছে; আমরা এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করি।
তিনি বলেন, অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আহ্সান উল্লাহ্ মাস্টার এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়ার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা তো সবসময় ছিল। আগে আহ্সান উল্লাহ্ মাস্টারের সঙ্গেও এ রকম হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা হয় বাংলাদেশে, এটা নতুন কিছু না’ (বিডিনিউজ২৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫)।
স্পষ্টত, সিইসি এগুলোকে সহিংসতা মনে করলেও গুরুতর সহিংসতা মনে করছেন না।
এই যে একটা গুরুতর অপরাধকে আমাদের দেখা ও তুলে ধরার ধরন, তার জন্যই সহিংসতা টিকে থাকে। আমরা গোষ্ঠীর বন্দনা করি; গোষ্ঠীর পক্ষে কথা বলি; গোষ্ঠীস্বার্থকে সত্য মনে করি; তাদের পক্ষ নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাই; সহিংসতার বিপক্ষে নয়।
তাই বলতে পারি না– অধ্যাপক জামালউদ্দিন বা হাদির সঙ্গে আমার মতানৈক্য, তর্ক-বিতর্ক, পছন্দ-অপছন্দের জায়গা থাকতে পারে। কিন্তু তা বলে তাদের ওপর আক্রমণের পাটাতনকে বৈধতা দেওয়া যায় না। এর অন্যথা মানেই হলো সহিংসতার জমিনকে শক্ত করা।
বিবেচনায় রাখতে হবে– এখন পর্যন্ত হাদিকে গুলি করা ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়নি।
সরকার, দৃশ্যত হাদিকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে এবং তাকে গুলিবর্ষণকারীর গ্রেপ্তারে সহযোগিতার জন্য ৫০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়েই তার কর্তব্য শেষ করার চেষ্টা করছে। যদিও নানা সূত্রের দাবি, ওই অভিযুক্তরা ইতোমধ্যে দেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে।
সরকারের কোনো সংস্থা– না গোয়েন্দা বিভাগ, না বিজিবি তা ঠেকাতে পেরেছে। ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসকদের সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে হাদি আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন।
দেশের মানুষ শোকে, ক্ষোভে রাস্তায় নেমে এসেছে। কিন্তু হাদির আততায়ীদের গ্রেপ্তারের কোনো ইঙ্গিতও দিতে পারেনি সরকার।
এই যে সহিংসতা ঠেকাতে বা এ অপরাধ সংঘটনকারীকে ধরতে সরকার কিছু করতে পারছে না, সেটাই কি নতুন সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে না?
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
এসআর
মন্তব্য করুন: