আমরা এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে স্বার্থপরতার গভীর ছাপ পড়েছে।
ব্যক্তির নৈতিক অবক্ষয় এখন আর কেবল ব্যক্তিগত বিপর্যয় নয়- এটি জাতির অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আমরা এক অদ্ভুত বাস্তবতায় বাস করছি, যেখানে “আমি” শব্দটি “আমরা”-কে গ্রাস করে ফেলেছে। দেশ, সমাজ বা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম—সবকিছুই ব্যক্তিগত স্বার্থের কাছে আজ তুচ্ছ। এই আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা আমাদের রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে আত্মহননের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
দুর্নীতি আজ আর বিচ্ছিন্ন কোনো অনৈতিক কাজ নয়; এটি প্রাতিষ্ঠানিক, কাঠামোগত এবং প্রায় বৈধ এক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
সরকারি প্রজেক্টে অনিয়ম এখন নিত্যদিনের ঘটনা—বাজেটের অর্ধেক টাকা খরচ হওয়ার আগেই “কমিশন” হিসেবে উধাও হয়ে যায়। নানা নামে দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হয়েছে—ফাইল আটকে ঘুষ নেওয়া, টেন্ডারে কারসাজি, প্রজেক্ট অনুমোদনে রাজনৈতিক প্রভাব, এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রেও অবৈধ টিউশন বাণিজ্য।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই অর্থ যদি দেশের উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ হতো, তবে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একদল স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী দেশের সম্পদ বিদেশে স্থানান্তর করছে, আর দেশ ক্রমশ ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। এই অর্থনৈতিক রক্তক্ষরণই হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রের নীরব আত্মহনন।
একটি দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি তার শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু আজ আমাদের শিক্ষাক্ষেত্র এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে গুণগত শিক্ষার বদলে চলছে সার্টিফিকেট উৎপাদনের প্রতিযোগিতা। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সবখানে কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ান্টিটির জয়গান। পাশের হার বাড়ানোর নামে শিক্ষার মান ধ্বংস করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র না হয়ে রাজনৈতিক দখলদারিত্ব ও সহিংসতার ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। গবেষণা কার্যক্রম সীমিত, পাঠ্যবই পুরনো, আর শিক্ষক নিয়োগেও রাজনীতির ছাপ। ফলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বড় অংশই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর কয়েক লাখ গ্র্যাজুয়েট বের হলেও, তাঁদের বেশিরভাগই দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হচ্ছে না।
তাঁদের মধ্যে কারিগরি দক্ষতা, সমসাময়িক প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও প্রায়োগিক অভিজ্ঞতার অভাব প্রকট। এই ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছে বিদেশি শ্রমিকরা—যারা আজ বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পে লাখ লাখ টাকা বেতনে কাজ করছে। অথচ আমাদের তরুণরা বেকারত্বে ভুগছে। এটি কেবল দুঃখজনক নয়, জাতীয় ব্যর্থতার প্রতীক।
বর্তমানে বাংলাদেশের কর্মজীবি লোকের সংখ্যা প্রায় ৬০% যার মধ্যে সিংহভাগই তরুণ—এ এক বিশাল ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। কিন্তু এই সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার না করতে পারলে সেটিই হবে সবচেয়ে বড় অভিশাপ। কর্মসংস্থানের অভাবে লক্ষ লক্ষ তরুণ রিকশা, টেম্পু বা অনলাইন ডেলিভারি পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। তাদের মেধা, শক্তি ও স্বপ্ন—সবই নষ্ট হচ্ছে অদক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাবে।
আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র এখনো বুঝতে পারেনি যে, তরুণদের বিদেশে পাঠিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা কতটা জরুরি। দেশে যতই কারখানা বা অফিস গড়া হোক না কেন, এই বিপুল সংখ্যক তরুণের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব নয়।
তাই এখন সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে—তরুণদের বিশ্বমানের কারিগরি শিক্ষা ও ভাষাগত দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করে বৈদেশিক চাকরির বাজারে পাঠানো। আজ ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, বা ভারতের উদাহরণ দেখলেই বোঝা যায়, কীভাবে তারা নিজেদের মানবসম্পদকে বৈশ্বিক অর্থনীতির অংশে পরিণত করেছে।
রাজনীতি এখন আর জনসেবার মাধ্যম নয়, এটি পেশা ও ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা মানে এখন টাকার খেলা। নির্বাচনে অংশ নিতে কোটি কোটি টাকা লাগে, এবং ক্ষমতায় আসার পর সেই টাকা পুনরুদ্ধারই প্রধান লক্ষ্য হয়ে যায়। জনগণ, নীতি, আদর্শ—সবই হারিয়ে গেছে।
এমনকি স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত দলীয় প্রভাব এখন সর্বত্র। মেধা নয়, আনুগত্যই হচ্ছে সাফল্যের মাপকাঠি। এই সংস্কৃতি তরুণ প্রজন্মের মনে এক ধরনের হতাশা, অবিশ্বাস ও বঞ্চনার বোধ তৈরি করছে। তারা দেখছে, মেধা বা পরিশ্রম নয়, টাকার জোরেই মানুষ সফল হচ্ছে। এটি জাতির আত্মাকে ধ্বংস করছে ধীরে ধীরে।
স্বার্থপরতা এখন সমাজের প্রতিটি স্তরে মিশে গেছে। মানুষ অন্যকে ঠকানো, অপমান করা, মিথ্যা বলা—এসবকে আর অপরাধ মনে করে না। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র—সবখানেই আত্মপ্রচারণা, হিংসা আর বিদ্বেষ। নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ আজ বিলুপ্তপ্রায়।
আইনকানুন প্রায়ই ধনীদের পক্ষে কাজ করে, গরিবের পক্ষে নয়। বিচার বিকৃত হয় টাকার বিনিময়ে। ফলে জনগণের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। একটি রাষ্ট্র তখনই ব্যর্থ হয়, যখন নাগরিকরা বিশ্বাস হারায় যে ন্যায়বিচার সম্ভব।
আমরা যদি এখনই পরিবর্তনের পথে না হাঁটি, তবে ইতিহাসের কবরস্থানে “ব্যর্থ রাষ্ট্র” হিসেবে আমাদের নাম লেখা হবে। আমাদের প্রয়োজন সমন্বিত নীতি—যেখানে থাকবে তিনটি প্রধান দিক:
শিক্ষা ব্যবস্থার দক্ষতাভিত্তিক রূপান্তর – প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প ও প্রযুক্তি-সংযুক্ত পাঠ্যক্রম চালু করতে হবে।
দুর্নীতি দমন ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা – প্রতিটি প্রজেক্টের আর্থিক লেনদেন ডিজিটাল পর্যবেক্ষণে আনতে হবে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি পুনর্গঠন – ক্ষমতাকেন্দ্রিক নয়, সেবাকেন্দ্রিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।
আমরা যদি তরুণদের মধ্যে নৈতিকতা, দক্ষতা এবং দেশপ্রেম জাগাতে পারি, তবে এখনও সময় আছে—রাষ্ট্রের এই আত্মহনন রোধ করা সম্ভব। অন্যথায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের দিকে আঙুল তুলে বলবে “তোমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বিক্রি করে দিয়েছিলে তোমাদের স্বার্থের কাছে।”
আজ প্রয়োজন কেবল নীতিকথা নয়, বাস্তব পদক্ষেপ—যা জাতিকে পুনর্জীবিত করবে, রাষ্ট্রকে স্বার্থপরতার করালগ্রাস থেকে মুক্ত করবে, আর আমাদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করবে।
লেখক- শিক্ষাবিদ ও গবেষক
ডিন, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স এবং ফ্যাকাল্টি অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং,
বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা
এসআর
মন্তব্য করুন: