[email protected] রবিবার, ১৮ মে ২০২৫
৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বুদ্ধিদীপ্ত বাঙালি জাতির সম্ভাবনা ও দিশাহীন প্রজন্ম

প্রফেসর ড. মোঃ আবদুল জলিল

প্রকাশিত: ১৭ মে ২০২৫ ১১:২৪ এএম
আপডেট: ১৭ মে ২০২৫ ১১:২৮ এএম

বাংলার মাটি বহুযুগ ধরে ছিল নানা জাতিগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির মিলনস্থল।

আরব, ফারসি, তুর্কি, আফগান, পাঠান, মোগল, ব্রিটিশ—একেক সময়ে একেক জাতিগোষ্ঠী এসেছে এই ভূখণ্ডে, কেউ বাণিজ্যের প্রয়োজনে, কেউবা শাসন বা সাম্রাজ্য বিস্তারের আশায়।

এই দীর্ঘ ইতিহাসের ফলে বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে এক বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতিগত সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে—যা কেবল চেহারা-গঠনে নয়, প্রভাব ফেলেছে বুদ্ধিমত্তা, মানসিকতা ও সৃজনশীলতাতেও। বাঙালির ভাবুকতা, কল্পনাশক্তি, সাহিত্যপ্রীতি, সংগীতের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ, মুক্তচিন্তার ধারা—এসবই যেন এই জাতিগত বৈচিত্র্যেরই স্বাভাবিক পরিণতি।

বিজ্ঞান বলে, জেনেটিক বৈচিত্র্য থেকে জন্ম নেওয়া জনগোষ্ঠী অনেক ক্ষেত্রে উচ্চতর মানসিক নমনীয়তা, সমস্যার সমাধানদক্ষতা ও সৃজনশীলতায় এগিয়ে থাকে। এই ‘হাইব্রিড ভিগার’ বা ‘হেটেরোসিস’-এর কারণে বাঙালিদের মধ্যে রয়েছে এক অনন্য সম্ভাবনা।

স্ট্যানফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাও বলছে, যেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য বেশি, সেখানেই বেশি বেশি জন্ম নেয় নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন ও উদ্দীপনা।
সাহিত্য থেকে রাজনীতি, বিজ্ঞান থেকে অর্থনীতি—রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মধুসূদন, জগদীশ চন্দ্র বসু ইনারা সবাই ছিলেন সেই বুদ্ধিদীপ্ত জাতির প্রতিনিধিত্বকারী কিছু উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম।
তবুও প্রশ্ন জাগে—এই সম্ভাবনাময় জাতি কেন আজ এতটা দিশাহীন? কেন আমরা প্রতিনিয়ত শুনি, আমাদের প্রজন্ম মানহীন, উদাসীন, আদর্শহীন? কোথায় যেন একটি ছেদ পড়েছে সম্ভাবনার ধারাবাহিকতায়।

সেই ছেদের উৎস কোথায়—এ প্রশ্ন আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে, একান্ত সততার সঙ্গে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আজকের তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে। তারা ঘন্টার পর ঘন্টা কাটায় মোবাইল ফোনে—গেম খেলে, অপ্রয়োজনীয় ভিডিও দেখে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে নিরর্থক ঘোরাফেরায় মেতে থাকে।

প্রযুক্তি হঠাৎ এসে যেভাবে আমাদের জীবনে ঢুকে পড়েছে, তার অভিঘাত আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। ফলে আজ এমন এক প্রজন্ম গড়ে উঠছে, যারা তথ্যের আধিক্যে ডুবে আছে, কিন্তু চিন্তার গভীরতায় ভীষণ রকম শূন্য।
শুধু প্রযুক্তির প্রভাব নয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও আজ সংকটে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত শিক্ষক নেই বললেই চলে। অনেকেই শিক্ষকতাকে কেবল চাকরি বা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন, জাতি গঠনের মহান দায়িত্ব হিসেবে নয়। পাঠদান কার্যক্রম হয়ে উঠেছে কেবল পাঠ্যবই পাঠ ও নোট মুখস্থের অনুশীলন।

বিশ্লেষণী দক্ষতা, যৌক্তিক চিন্তা কিংবা সৃজনশীলতার চর্চা সেখানে অনুপস্থিত। শিক্ষা যেন হয়ে উঠেছে কেবল নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতা, আর তার ফলেই তৈরি হচ্ছে এমন সব ‘মেধাবী’ গ্র্যাজুয়েট, যারা চাকরির বাজারে টিকতে পারছে না, জীবনের বাস্তবতায় খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হচ্ছে।

শিক্ষাব্যবস্থার এই অবক্ষয়ের সাথে জড়িত রয়েছে রাজনীতি ও দুর্নীতির কুপ্রভাবও। শিক্ষক নিয়োগ, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন—সব জায়গাতেই দলীয়করণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার স্পষ্ট। শিক্ষাঙ্গনে যখন দলীয় রাজনীতি ঢুকে পড়ে, শিক্ষার্থী তখন আদর্শের পাঠ না নিয়ে ঘৃণার চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য তখন হারিয়ে যায়, আর জাতি হারায় তার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব।
এ সংকটের একটি সামাজিক মাত্রাও রয়েছে। অভিভাবকেরা আজ সন্তানকে মানুষ করার চেয়ে ডাক্তার, প্রকৌশলী কিংবা বিসিএস ক্যাডার বানাতে ব্যস্ত। শিশুকাল থেকেই চাপ, প্রতিযোগিতা ও তুলনার যাঁতাকলে পড়ে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের মনে গড়ে ওঠে না মানবিকতা, দায়িত্ববোধ কিংবা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা।

তারা শেখে কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবতে, কেবল সফল হতে—সচেতন নাগরিক হতে নয়।
এসব মিলিয়ে এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে—একটি জাতি, যার রক্তে মেধা ও মননের উত্তরাধিকার প্রবহমান, আজ তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে শঙ্কিত। অথচ এই বাঙালি জাতিই যুগে যুগে জন্ম দিয়েছে বিশ্বমানের চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও বিপ্লবী। সেই উত্তরাধিকার আজ যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে দিশাহীনতার ধুলোয়।
তবে আশার কথা হলো—এখনো সময় আছে ঘুরে দাঁড়াবার। আমাদের প্রয়োজন নতুন করে ভাবার।

শিক্ষা ব্যবস্থাকে শুধু পাঠ্যপুস্তকের গণ্ডি থেকে মুক্ত করে ভাবতে হবে একটি জাতীয় কাঠামো হিসেবে, যার লক্ষ্য হবে মানবিকতা ও চিন্তার বিকাশ। শিক্ষক হতে হবে অনুপ্রেরণার উৎস, গবেষণার পথপ্রদর্শক।

পরিবারে, বিদ্যালয়ে এবং রাষ্ট্রে—সবার মাঝে গড়ে তুলতে হবে একটি অভিন্ন চেতনা, যেখানে শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে কেবল চাকরি পাওয়া নয়, মানুষ গড়া।
আমাদের প্রয়োজন এক বিবেকবান সমাজ, যারা বুঝবে—প্রযুক্তির ব্যবহার কেমন হবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতি ও সততার গুরুত্ব কতখানি, এবং একটি জাতির প্রকৃত উন্নয়ন কীভাবে ঘটে। যদি আমরা এই বোধ থেকে দূরে থাকি, তবে কেবল অবকাঠামো উন্নয়নে জাতির উন্নয়ন হবে না। বরং মানুষ, চিন্তা ও মূল্যবোধে পিছিয়ে পড়বে জাতি, আর সেটাই হবে সবচাইতে বড় বিপর্যয়।
এই সমাজ, এই দেশ, এই জাতি—সবই আমাদের, ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আমাদেরই। তাদের হাতেই দেশকে তুলে দিতে হবে। কিন্তু তারা যদি প্রস্তুত না হয়, যদি তারা না জানে কিভাবে সৎ থাকতে হয়, চিন্তা করতে হয়, নেতৃত্ব দিতে হয়—তবে তারা কীভাবে এই জাতিকে এগিয়ে নেবে? এখনই সময়, তাদের সেই প্রস্তুতির পথ রচনা করার।

লেখকঃ 
ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি ও
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর