[email protected] রবিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫
৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

খসড়া চূড়ান্ত

কৃষিজমি বাণিজ্যিক আবাসন বা অকৃষিকাজে ব্যবহারে পেতে হবে শাস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ১০:২৬ এএম

অপরিকল্পিত শহরায়ন ও উন্নয়নকাজের কারণে দেশে

কৃষিজমির পরিমাণ দ্রুত কমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষিজমি সংরক্ষণ, ভূমি ব্যবহারের জোনভিত্তিক পরিকল্পনা এবং পাহাড়-টিলা, বনভূমি, জলাধারসহ পরিবেশগত ভূমি রক্ষার জন্য সরকার ‘ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি ভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণয়ন করেছে। এই আইনের আওতায় অনুমতি ছাড়াই কৃষিজমি অকৃষি কাজে ব্যবহারে বা আবাসন, রিসোর্ট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

ভূমি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে খসড়া চূড়ান্ত করেছে এবং উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন শেষে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে এটি কার্যকর হবে।

অধ্যাদেশ প্রণয়নের কারণ

খসড়ায় উল্লেখ করা হয়— জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত বাসস্থান নির্মাণ, শিল্প স্থাপন, রাস্তা-ঘাট নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে ভূমির প্রকৃতি ও ব্যবহার দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে কৃষিজমি ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিজমি রক্ষা ও ভূমিরূপ অনুযায়ী সঠিক পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা থেকেই এ অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছে।

এটি রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান ছাড়া পুরো দেশে কার্যকর হবে।


ভূমি ব্যবহার জোনিং ম্যাপ

অধ্যাদেশের ৪ ধারায় বলা হয়েছে— আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে দেশের সব ভূমির ব্যবহার, বৈশিষ্ট্য ও প্রাকৃতিক ধরন বিবেচনায় ‘ভূমি ব্যবহার জোনিং ম্যাপ’ তৈরি করা হবে।
এই ম্যাপ একযোগে অথবা ধাপে ধাপে তৈরি হতে পারে। পাশাপাশি সরকার স্থানিক (spatial) পরিকল্পনার সঙ্গে এই ম্যাপের সামঞ্জস্য নিশ্চিত করবে।

ভূমি জোনিংয়ের শ্রেণিবিন্যাস

৬ ধারায় ভূমি ১৮ ধরনের জোনে ভাগ করার নির্দেশ রয়েছে—
কৃষি অঞ্চল, বিশেষ কৃষি অঞ্চল, কৃষি-মৎস্য অঞ্চল, নদী-খাল, জলাভূমি, পরিবহণ এলাকা, আবাসিক, গ্রামীণ বসতি, মিশ্র ব্যবহার, বাণিজ্যিক, শিল্প এলাকা, প্রতিষ্ঠান/সুবিধা অঞ্চল, বনভূমি, পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল এলাকা, সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্য অঞ্চল, পাহাড়-টিলা, পতিত জমি ও অন্যান্য।

প্রয়োজনে সরকার নতুন জোন তৈরি, পুরোনো জোন একীভূত বা বাতিল করতে পারবে।


ভূমি সুরক্ষার বিধান

৭ ধারায় বলা হয়েছে— সরকারি সংস্থা ও জেলা প্রশাসন ভূমির প্রকৃতি অনুযায়ী কৃষিজমি ও অন্যান্য সুরক্ষাযোগ্য ভূমির তালিকা প্রস্তুত করবে।

নাল-বিল, ধানি জমি, বোরো জমি, বাগান, পান বরজ, চর ভূমি, ঘাসবন, নার্সারি, মাঠ, বাঁশঝাড়, চারণভূমি, পুকুরপাড়সহ নানাবিধ আবাদি বা আবাদযোগ্য জমি কৃষিভূমি হিসেবে গণ্য হবে।

সরকার দ্রুত কৃষিজমির ম্যাপিং শুরু করবে।
বিশেষ কৃষি অঞ্চল ঘোষিত জমি শুধুমাত্র কৃষিকাজেই ব্যবহৃত হতে পারবে।

দুই-তিন-চার ফসলি জমি কোনো অবস্থাতেই অকৃষিকাজে ব্যবহার করা যাবে না, তবে জ্বালানি বা খনিজ অনুসন্ধানের মতো জাতীয় প্রয়োজনে সীমিত অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। দেশের মোট কৃষিজমির ১০%-এর বেশি কোনো ক্ষেত্রেই অকৃষিকাজে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যাবে না।

ইটভাটার জন্য কৃষিজমির ওপরের মাটি, পাহাড়-টিলার মাটি বা জলাধারের মাটি ব্যবহার নিষিদ্ধ।
জলাধার ভরাট, পাহাড় কাটা বা বন উজাড় করা কোনো উন্নয়ন প্রকল্পেই অনুমোদিত হবে না।

অবৈধভাবে ভরাট বা নির্মিত স্থাপনা অপসারণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই নিতে হবে।

জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব

জেলা প্রশাসকের প্রধান দায়িত্বগুলো হলো—

কৃষিজমির তালিকা ও সুরক্ষা

জলাভূমি, পাহাড়-টিলা ও বনভূমির তালিকা ও সীমানা নির্ধারণ

গো-চারণভূমি সংরক্ষণ

ইটভাটার জন্য মাটির উৎস চিহ্নিত করা

ড্রেজিং-করা মাটির বাইরে অন্য মাটি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ

সরকার কর্তৃক দেওয়া অন্যান্য নির্দেশ বাস্তবায়ন

নিজস্ব জমিতে নির্মাণ

১০ ধারায় বলা হয়েছে— স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতির ভিত্তিতে নিজস্ব কৃষিজমিতে বসতবাড়ি, উপাসনালয়, কবরস্থান, গুদাম, পারিবারিক পুকুর বা কুটির শিল্প স্থাপন করা যাবে। অনুমতি ছাড়া নির্মাণ করলে তা অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হবে।

জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন

১১ ধারার নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমি, পাহাড়-টিলা, জলাভূমি বাদে অন্যান্য ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। পরিবেশ বা জনস্বার্থের ক্ষতি হবে না— এমন নিশ্চয়তা থাকতে হবে।

অপরাধ ও দণ্ড

১৪ ধারায় শাস্তির বিধান উল্লেখ করা হয়েছে—

অনুমতি ছাড়া ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন: সর্বোচ্চ ৬ মাস কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা

কৃষিজমি অকৃষিকাজে ব্যবহার: সর্বোচ্চ ১ বছর কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা

কৃষিজমিতে আবাসন, রিসোর্ট, শিল্প স্থাপন নির্মাণ: সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা ৪ লাখ টাকা জরিমানা

ইটভাটায় কৃষিজমির বা পাহাড়-টিলার মাটি ব্যবহার: সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা ৪ লাখ টাকা জরিমানা


বিশেষ কৃষি অঞ্চলে ক্ষতি করলে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
জলাধার-পাহাড়-বনের ক্ষতির ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনের শাস্তির পাশাপাশি পুনঃস্থাপন বা স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হবে।

অপরাধে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জব্দ করা যাবে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ বলেছেন— উন্নয়ন কার্যক্রমে কৃষিজমি দ্রুত কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই কৃষিজমি সংরক্ষণ ও বন, পাহাড়-টিলাসহ পরিবেশগত ভূমি রক্ষায় এ অধ্যাদেশ অত্যন্ত জরুরি।

 

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর