নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল প্রকল্পের (এমআরটি লাইন–১) দুটি নির্মাণ প্যাকেজের ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে চায় সরকার।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) পক্ষ থেকে গত রোববার ও সোমবার জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা)
প্রধান কর্মকর্তার কাছে পাঠানো দুটি পৃথক চিঠিতে এই প্রস্তাব জানানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেন প্রকল্প পরিচালক মো. আফতাব হোসাইন।
ডিএমটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের ৭১তম সভার (২৯ সেপ্টেম্বর) সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই এ চিঠি পাঠানো হয়। সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়—যেসব ঠিকাদার প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাবের (ডিপিপি) নির্ধারিত ব্যয়ের তুলনায় অতিরিক্ত দর চেয়েছে, তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা যেতে পারে। তবে “অত্যধিক ব্যয়” বলতে কত শতাংশ বেশি দর বোঝানো হবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি।
জাইকাকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দুই ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে ডিএমটিসিএল আগ্রহী। জাইকার ঋণচুক্তির ধারা ও নির্দেশিকা অনুসারে এ বিষয়ে সম্মতি জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, ডিপিপির তুলনায় চুক্তিমূল্য “উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি” হওয়ায় এই পদক্ষেপ প্রয়োজন হয়েছে।
বাতিলের প্রস্তাব দেওয়া দুটি প্যাকেজ হলো—
দুটি প্রতিষ্ঠানই সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ পেয়েছিল।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুখ আহামেদ বলেন,
“চিঠি পাঠানো হয়েছে আলোচনার পথ তৈরির জন্য। এখনই ঠিকাদার বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়নি। যদি আলোচনার মাধ্যমে ব্যয় কমে আসে, তাহলে তারাই কাজ চালিয়ে যাবে। না হলে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হবে। অতিরিক্ত ব্যয়ে কাজ চালানো সম্ভব নয়।”
তিনি আরও বলেন,
“২০১৯ সালের দরের সঙ্গে ২০২৪ সালের বাজারদরের পার্থক্য স্বাভাবিক। মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের বিনিময় হার—সব মিলিয়ে মূল দরের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এর বেশি হলে তা ‘বেশি’, আর ৫০ শতাংশের বেশি হলে ‘অতিরিক্ত’ হিসেবে বিবেচিত হবে।”
তবে এই দুই ঠিকাদার কত শতাংশ বেশি দর চেয়েছে, তা তিনি জানাতে পারেননি।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাতাল মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ডিপো নির্মাণের মধ্য দিয়ে কাজের সূচনা হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণ শেষ করা। কিন্তু এক বছরের বেশি সময়েও প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এখনো সব প্যাকেজের চুক্তি সম্পন্ন করা যায়নি।
সূত্র জানায়, আগের সরকারের সময়ে স্বাক্ষরিত কিছু চুক্তি নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অনিশ্চয়তায় রয়েছে। ফলে কিছু প্যাকেজে ঠিকাদার মনোনীত হলেও চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি। কর্তৃপক্ষ চায়, সব প্যাকেজের চুক্তি একসঙ্গে সম্পন্ন করে কাজ শুরু করতে। ব্যয় নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে প্রয়োজনে জাইকার ঋণচুক্তি বাতিলের কথাও ভাবা হচ্ছে এবং বিকল্প অর্থায়নের উৎস খোঁজা হচ্ছে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন,
“ব্যয় কমানোর প্রক্রিয়াটি আরও স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। আলোচনা করতে চাইলে চুক্তি বাতিলের কথা উল্লেখ করে চিঠি পাঠানো কেন—এটি পরিষ্কার নয়। ব্যয় পর্যালোচনার জন্য গঠিত কমিটি কী মত দিয়েছে, সেটিও প্রকাশ করা জরুরি। কারণ বিষয়টি কেবল অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিক প্রভাবও ফেলতে পারে।”
কাঞ্চন সেতু থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ৩১.২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন–১–এর মধ্যে ১৯.৮৭ কিলোমিটার পাতাল এবং ১১.৩৭ কিলোমিটার উড়ালপথে যাবে।
মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যার মধ্যে জাইকা দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি ৩২ লাখ এবং সরকার বহন করবে ১৩ হাজার ১১১ কোটি ১১ লাখ টাকা।
২০১৯ সালে প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু হয়—তখনই ভূমি অধিগ্রহণ, নকশা ও পরামর্শক নিয়োগের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়। কিন্তু সর্বশেষ ডিএমটিসিএল বোর্ড সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে,
“এমআরটি লাইন–১ ও ৫ (উত্তর ও দক্ষিণ)-এর কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে পূর্ণমাত্রায় কার্যক্রম শুরু হওয়ার সম্ভাবনা কম।”
সরকার পাতাল মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুই ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এটি আপাতত আলোচনার কৌশল হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যয় ও কূটনৈতিক ভারসাম্য একসঙ্গে বজায় রাখার মধ্য দিয়েই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
এসআর
মন্তব্য করুন: