[email protected] বৃহঃস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫
১ কার্তিক ১৪৩২

রূপনগর ঢাকায় আরেক ‘রাসায়নিক বোমা’!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১:৩০ পিএম

সংগৃহীত ছবি

পুরান ঢাকার নিমতলী ও চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—জনবসতি এলাকায় রাসায়নিকের অবৈধ মজুত কেমন প্রাণঘাতী হতে পারে।

এবার সেই একই চিত্র ধরা পড়ল মিরপুরের রূপনগরে। পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হওয়া সত্ত্বেও রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে মঙ্গলবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করেছে, ঢাকায় আরেকটি ‘রাসায়নিক বোমা’ ঘুমিয়ে আছে মানুষের বসতবাড়িতেই।

এই ঘটনায় ১৬টি প্রাণহানি ও একাধিক মানুষ দগ্ধ হওয়ার পর আবারও শুরু হয়েছে রাসায়নিকের অবৈধ গুদামবিরোধী তোড়জোড়। অথচ এর আগেও বহু প্রাণ গেছে একই অব্যবস্থাপনায়—কিন্তু পরিবর্তন ঘটেনি তেমন কিছুই।

২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে আগুনে ১২৪ জন প্রাণ হারানোর পর সরকার শ্যামপুর ও মুন্সীগঞ্জে কেমিক্যাল পল্লি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ১৫ বছর পেরিয়েও সেই উদ্যোগ আজও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। এর মধ্যেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে আরও অগণিত অবৈধ কেমিক্যাল গুদাম।

‘এম এস আলম ট্রেডিং’–এর মারণ গুদাম

রূপনগর আবাসিক এলাকার ৩ নম্বর সড়কের একটি দোতলা ভবনের নিচতলায় গোপনে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘এম এস আলম ট্রেডিং’ নামে কেমিক্যালের গুদাম। সেখান থেকেই মঙ্গলবারের আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের তৈরি পোশাক কারখানায়, মুহূর্তেই দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান নারীসহ ১৬ জন শ্রমিক। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে এখনও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তিনজন।

ফায়ার সার্ভিস জানায়, গুদামটি ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। উচ্ছেদের জন্য তিনবার নোটিশ দেওয়া হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে সেই অবহেলাই কেড়ে নিল ১৬টি প্রাণ।

‘বিস্ফোরণ ঘটার অপেক্ষায় রূপনগর’

স্থানীয়রা বলছেন, রূপনগর ও আশপাশের এলাকায় দ্রুত বাড়ছে কেমিক্যাল, পেইন্ট ও প্লাস্টিক সামগ্রীর গুদাম। এসব ভবনের নিচতলায় নেই ফায়ার সেফটি, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা কিংবা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র।

বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,

“আবাসিক এলাকায় এসব কেমিক্যাল গুদামের কারণে আমরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। সামান্য আগুনই পুরো এলাকা ধ্বংস করে দিতে পারে—তার প্রমাণ তো সামনে।”

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন,

“আমরা মঙ্গলবার সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করি। গার্মেন্টসের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও কেমিক্যাল গুদামটির আগুন নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করতে সময় লাগে বুধবার দুপুর ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত।”

তিনি আরও জানান, গুদামটি অভিযানের পর্যায়ে ছিল এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে আগেই বিষয়টি জানানো হয়েছিল।

তবে আগুন নিয়ন্ত্রণের পরও বুধবার বিকেল পর্যন্ত ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস বের হতে দেখা যায়। এতে পাশের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে সাত-আটজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. মাহমুদুল হাসান জানান,

“অনেকের শ্বাসকষ্ট, কাশি ও অচেতনতা দেখা দিয়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।”

বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানীর নানা এলাকায় এখনো বহু ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গুদাম সক্রিয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পূর্বে অভিযান হলেও তা সম্পূর্ণ হয়নি। এমন অব্যবস্থাপনা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল হক বলেন,

“ঢাকার মানুষ যেন একেকটা অ্যাটম বোমার পাশে বসবাস করছে। এসব কেমিক্যাল সরানোর উদ্যোগ বারবার ব্যর্থ হয়, আর আমরা হারাই আমাদের প্রিয়জনদের।”

অগ্নিকাণ্ডে নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে ২ লাখ টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

এ ছাড়া ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সমাজকল্যাণ ও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন,

“যারা অবৈধভাবে কেমিক্যাল মজুত রেখেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।”

অন্যদিকে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মঙ্গলবার রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ১ লাখ টাকা করে সহায়তার ঘোষণা দেন। তিনি এ ঘটনাকে ‘বেদনাদায়ক’ উল্লেখ করে দোষীদের দ্রুত বিচারের দাবি জানান।

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর