[email protected] রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫
৫ শ্রাবণ ১৪৩২

ভিন্নমতকে 'হুমকি' আখ্যা দিত হাসিনার সরকার: গুম কমিশনের প্রতিবেদন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৮ জুন ২০২৫ ৫:৪৫ পিএম

সংগৃহীত ছবি

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভিন্নমত ও সমালোচনাকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হতো বলে জানিয়েছে গুম কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তদন্ত প্রতিবেদন।

বিশেষ করে শেখ হাসিনা, তাঁর সরকার ও দলীয় নেতাদের সমালোচনা এবং সামাজিক মাধ্যমে কটাক্ষমূলক পোস্টকেও 'অস্থিতিশীলতার উৎস' বলে বিবেচনা করে কঠোর দমননীতি অনুসরণ করা হতো।

সোমবার (১৭ জুন) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের মাধ্যমে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার করে সরকার ভিন্নমত দমন করত। বিশেষ করে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো গণআন্দোলন দমনেও একই কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব মামলার এজাহার ও চার্জশিটে প্রায় একই ভাষা ব্যবহার করা হতো—যেন একটি পূর্ব নির্ধারিত স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ‘গোয়েন্দা তথ্যে ভিত্তি করে’ বেনামি সূত্র দিয়ে অভিযান চালানো এবং পালানোর সময় গ্রেফতারের চিত্র আঁকা হয়েছে। এতে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারকেও ‘আইনসম্মত’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

কমিশনের ভাষায়,

“এসব অভিযোগে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও পুলিশি পদক্ষেপকেই প্রাধান্য দেওয়া হতো, যা দেশে একপ্রকার জবাবদিহিহীন পুলিশিং সংস্কৃতি গড়ে তোলে।”

প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, গ্রেফতারের পর তাৎক্ষণিক ‘স্বীকারোক্তি’ আদায়ের প্রবণতা ছিল অত্যন্ত সাধারণ। সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার স্বীকারোক্তি আদায় করা হতো; যদিও এই ধরনের তাৎক্ষণিক স্বীকারোক্তি আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়।

জব্দকৃত ‘জঙ্গিবাদী’ নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলো ছিল ধর্মীয় সাহিত্য। অথচ গণমাধ্যমের সামনে তা ‘জিহাদি পুস্তক’ আখ্যা দিয়ে প্রদর্শন করা হতো। একটি ব্যাগ বা ড্রয়ারে রাখা এসব বইপত্রকে ‘সন্ত্রাসী প্রমাণ’ হিসেবে প্রচার করা হতো নিয়মিতভাবে।

কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, এসব মামলার বিচারিক প্রক্রিয়াও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক মামলায় দীর্ঘদিন স্থগিতাদেশের নামে ভুক্তভোগীদের আইনি অনিশ্চয়তায় রাখা হতো। এতে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক বিপর্যয়েরও শিকার হয়েছেন অনেকে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, একাধিক পরিবার তাদের বার্ষিক আয়ের দ্বিগুণ খরচ করে মামলা লড়েছে। কেউ কেউ জমিজমা বিক্রি করে বা ঋণ নিয়ে আইনি লড়াই চালিয়েছে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

এক কিশোরের মানসিক বৈকল্যের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, তাকে নির্যাতনের পর বারবার তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হতো, যা তার ওপর আরও চাপ তৈরি করত।

প্রতিবেদনে বিচারব্যবস্থার ওপর রাজনৈতিক প্রভাবের কথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালতগুলো এসব মামলায় বিচারিক নিয়মনীতি অনুসরণ না করে রাজনৈতিক স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছে কমিশন।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের হাজার হাজার মামলার ন্যায়সংগত নিষ্পত্তি এখন দেশের বিচারব্যবস্থার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। একইসঙ্গে সামরিকীকরণের পরিবর্তে প্রতিরোধমূলক ও পুনর্বাসনমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

তারা আরও মনে করেন, বিচারকদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হলে আপিল বিভাগের সুস্পষ্ট নির্দেশনা মেনে বিচারকাজ পরিচালনা করা জরুরি। এতে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর