২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে ডিবি পুলিশের পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় ছাত্রদল কর্মী খালেদ হাসান সোহেলকে।
সেই থেকে নিখোঁজ বাংলাবাজারের বাসিন্দা সোহেলের কোনো খোঁজ মেলেনি। পরিবারের বড় সন্তানকে হারিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন স্বজনরা। স্ত্রী সৈয়দা শাম্মী সুলতানা নিপা একমাত্র সন্তানকে নিয়ে চরম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় দিন পার করছেন। স্বামী জীবিত না মৃত—এ অনিশ্চয়তার কারণে সন্তানের উত্তরাধিকার নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা।
একই রকম দুর্ভোগের শিকার মিরপুর শাহ আলী মাজার এলাকার কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনের পরিবার। ২০১৯ সালের ১৯ জুন নিখোঁজ হন তিনি। এখনো তার খোঁজ মেলেনি। তার স্ত্রী নাসরীন আক্তার জানান, স্বামীর ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারছেন না, কারণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া নমিনি হিসেবে অর্থ উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়। দুই সন্তান নিয়ে চরম কষ্টে দিন কাটছে তাদের।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের বহু পরিবার এমন জটিল সমস্যায় ভুগছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব, সম্পত্তি বা অন্য আর্থিক লেনদেনে তাদের স্বজনেরা কোনো ধরনের অধিকার প্রয়োগ করতে পারছেন না। এতে করে এসব পরিবার চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছে।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান বলেন, “গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার যেন তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছি। যাদের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি, তাদের স্ত্রী-সন্তান যেন ব্যাংক হিসাব পরিচালনা, সম্পত্তি বিক্রয় বা ভোগ করতে পারেন, সেই আইনি কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন।”
এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ সপ্তাহ উপলক্ষে শনিবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে ‘অধিকার’। সেখানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সম্পদ-সংক্রান্ত জটিলতা নিয়েও আলোচনা হবে এবং সরকারের প্রতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ জানানো হবে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর বহু গুম হওয়া ব্যক্তি গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ৩০০ জন। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানেন না স্বজনরা।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে তদন্তের জন্য গুম-সংক্রান্ত একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। কমিশনের কাছে ইতোমধ্যে নিখোঁজ ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে ১,৮০০-এর বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে।
কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন জানান, নিখোঁজদের পরিবার যেন আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য কাজ করছে কমিশন। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে এবং ঈদের পর আরেকটি বিস্তারিত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, “কমিশন যেসব নিখোঁজ ব্যক্তির বিষয়ে তদন্ত করে নিশ্চিত হতে পারছে, তাদের পরিবারকে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে, যাতে তারা আইনগতভাবে সম্পদ বা অর্থ ব্যবহারে অধিকার পায়।” পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও আদালতকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে বলে জানান তিনি।
সরকার ইতোমধ্যে একটি গুম প্রতিরোধ অর্ডিনেন্সের খসড়া প্রণয়ন করেছে। অর্ডিনেন্সটি বাস্তবায়িত হলে নিখোঁজদের পরিবার অর্থনৈতিক ও আইনি সুরক্ষা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এসআর
মন্তব্য করুন: