news.protidinerbangla22@gmail.com শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৪ আশ্বিন ১৪৩১

১৫ অ্যাকাউন্ট থেকে ৬০ কোটি টাকা তুলে নেন বেনজীর

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১ জুন ২০২৪ ১১:৫১ এএম

দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয়েছে যে, গত দেড় মাসের ব্যবধানে ফিক্সড ডিপোজিটগুলো ভেঙে ফেলেছেন বেনজীর আহমেদ।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহেমেদ, তার স্ত্রী-সন্তান ও একজন স্বজনের নামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তালিকার বাইরে আরও ১৫টি ফিক্সড ডিপোজিট (স্থায়ী আমানত) হিসাবের খোঁজ মিলেছে।

 

দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয়েছে যে, গত দেড় মাসের ব্যবধানে ফিক্সড ডিপোজিটগুলো ভেঙে ফেলেছেন বেনজীর আহমেদ। এমনকি চূড়ান্তভাবে হিসাবগুলো নিষ্পত্তি করা হয়েছে। ওইসব হিসাবে সুদে-আসলে প্রায় ৬০ কোটি টাকার মতো জমা ছিল। তাছাড়া দুদকের তালিকাভুক্ত ৩৩টি হিসাব শাখা থেকেও কিছু টাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে কত টাকা সরানো হয়েছে, তার কোনো হিসাব বের করতে পারেনি দুদকসহ অন্য তদন্তকারী সংস্থা।

 

এদিকে বেনজীর আহমেদ সপরিবারে সিঙ্গাপুর চলে গেছেন বলে জানা গেছে। পুলিশের একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন, গত ৪ মে রাতে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যরা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে   ঢাকা ছেড়েছেন।

 

উল্লেখ্য, দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ মে বেনজীর ও তার পরিবারের বিপুল পরিমাণ জমি ও ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দেয় আদালত। এরপর আরও কিছু সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ আসে। এসব সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে ৬ জুন বেনজীরকে দুদকে তলব করা হয়েছে। তার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে তলব করা হয়েছে ৯ জুন।

 

১৫ ফিক্সড ডিপোজিট হিসাবে টাকা নেই : বেনজীর ও তার পরিবারের যেসব ব্যাংকে এসব হিসাব ছিল তার তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। দুদকও এ নিয়ে অনুসন্ধান করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), দুদক ও কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা এ কাজ করছে বলে পুলিশের একটি গোয়েন্দা শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকে তার ডিপোজিট হিসাবগুলো ছিল। বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জা, তিন মেয়ে ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়ী, মেয়াদি, এসএনডি আমানত হিসাব। কিছু ঋণ হিসাবও আছে। তার মধ্যে পদ্মা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকে এসব হিসাব আছে।

 

এপ্রিলে একটি জাতীয় দৈনিকে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদ থাকা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এরপর সরকারি দলের এক সংসদ সদস্য তার বিপুল সম্পদের উৎসের অনুসন্ধান চেয়ে দুদকে আবেদন করেন। এসব ঘটনার মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথাও বেনজীর জানতে পারেন। আর সে কারণে সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগেই ফিক্সড ডিপোজিটগুলো ভেঙে ফেলেন বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থাগুলোর।

 

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ওই কর্মকর্তা বলেন, এমনভাবে হিসাবগুলো বন্ধ করা হয়েছে, যে কারোর পক্ষে এর অস্তিত্বও পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। বিষয়টি তারা কিছুদিন আগে আঁচ করতে পেরেছেন। তাছাড়া দুদকের তালিকাভুক্ত ৩৩টি হিসাবের মধ্যে কয়েকটি হিসাব থেকে টাকা তোলা হয়েছে। দুদক যে সময় জব্দ করার প্রক্রিয়া শুরু করে তার আগেই বেনজীর আহমেদ টাকা সরিয়ে ফেলেন বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।

 

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বেনজীর আহমেদ দেশের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয়টি আগে থেকেই চূড়ান্ত করেছেন। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন। তাদের কাছে তথ্য আছে, তিনি দুবাইও যেতে পারেন। তবে পরিস্থিতি তার অনুকূলে এলে হয়তো তিনি দেশে আসবেন এবং দুদকের নোটিসের জবাব দিতে পারেন। সবকিছু নির্ভর করবে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর।

 

দুদকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন ও বিধি অনুসারে যা যা করা দরকার, করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। তবে তারা জানতে পেরেছেন জব্দ করার আগেই কিছু হিসাব থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। যেসব ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তোলা হয়েছে সেগুলোর তালিকা তারা করেননি। তাছাড়া তালিকাভুক্ত হিসাবের মধ্যে কয়েকটি থেকেও যে কিছু টাকা তোলা হয়েছে, সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। অনুসন্ধান কর্মকর্তা আইন-বিধি অনুসারে কাজ করছেন।

তবে তিনি বলেন, বেনজীর আহমেদ দেশে না বাইরে আছেন, সেই বিষয়ে তারা অবগত নন। তাকে ও তার স্ত্রী-সন্তানকে তলব করা হয়েছে। দেখা যাক, তারা আসেন কি না। তারা যদি তলব করার তারিখ পেছানোর আবেদন করেন, তাহলে কমিশন বিষয়টি দেখবে।

 

সিঙ্গাপুর চলে গেছেন সাবেক আইজিপি : পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ দেশের বাইরে যাচ্ছেন বলে তার স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের বলেছেন। তবে সরকারের শীর্ষ মহলের একাংশকে দেশত্যাগের বিষয়টি অবহিত করেই তিনি দেশ ছেড়েছেন।

নাম প্রকাশ না করে বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠ এক পুলিশ কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, দুদকে তলব করাসহ সবকিছুর বিষয়ে তিনি আগাম ওয়াকিবহাল ছিলেন। প্রভাবশালী একটি মহল তাকে আগাম সবকিছু বলে দিয়েছিল।

 

এ কর্মকর্তা আরও বলেন, মামলা লড়তে বেনজীর একটি আইনজীবী প্যানেল ঠিক করেছেন। সরকারের শীর্ষ মহলকেও বোঝানোর চেষ্টা করছেন, যেভাবে বলা হচ্ছে সেভাবে তিনি কোনো অপরাধ করেননি। দুদকের তলব করার বিষয়ে তিনি সময় চাইতে পারেন বলে তারা শুনেছেন।

পরিস্থিতি বুঝে বেনজীর দেশে আসতে পারেন এমন তথ্য জানিয়ে তার ঘনিষ্ঠ ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, পরিস্থিতি ভালো মনে হলে ৬ জুনের মধ্যে সাবেক আইজিপি দেশে আসবেন এবং আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন।

 

দুদক সূত্র জানায়, অভিযোগ ওঠার পর বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দিয়েছে আদালত। বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। তাছাড়া জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা (৯১ একর) জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটও জব্দের আদেশ দেয় আদালত। বেনজীর পরিবারের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। সাভারে তাদের কিছু জমিও পড়েছে একই আদেশের মধ্যে।

 

২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন বেনজীর আহমেদ। এর আগে তিনি   ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাব এবং র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। ওই সময় আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর