[email protected] শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫
২৭ পৌষ ১৪৩১

অক্সফামের প্রতিবেদন

এবারো শ্রম অধিকার লঙ্ঘনে বিশ্বে অন্যতম বাংলাদেশ

সাইদুর রহমান

প্রকাশিত: ২২ অক্টোবর ২০২৪ ১২:৪৫ পিএম
আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৪ ১২:৪৭ পিএম

বিশ্বের যেসব দেশে শ্রমিক অধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। এ তালিকায় বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে আফগানিস্তান, জর্ডান এবং জিম্বাবুয়ে।

অক্সফামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের সবচেয়ে নিচের ১০টি দেশের মধ্যে। ১৬৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬১তম। শ্রমিকের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থা খুবই খারাপ, যেখানে দেশের অবস্থান ১৫৫তম।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম ও ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশনাল যৌথভাবে প্রকাশিত ‘দ্য কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইনইক্যুয়ালিটি (সিআরআই) ইনডেক্স ২০২৪’ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে, যেখানে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

অসমতা হ্রাসের অঙ্গীকার সূচকে বাংলাদেশ ২০২৪ সালে ১৭ ধাপ পিছিয়ে ১২৪তম স্থানে নেমে গেছে, যেখানে ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৭তম। ২০১৮ সালে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৮তম এবং ২০২০ সালে ১১৩তম।

প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশে বৈষম্য কমানোর প্রচেষ্টা মূল্যায়ন করা হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক থেকেই পিছিয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি যেসব দেশে শ্রম অধিকার সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়েছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম।

২০২৪ সালের প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, ৮৪ শতাংশ দেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমিয়েছে। ৮১ শতাংশ দেশ প্রগ্রেসিভ ট্যাক্স বা ধনীদের ওপর অধিক হারে কর আরোপের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। এছাড়া ৯০ শতাংশ দেশ শ্রমিকবান্ধব শ্রমনীতি প্রণয়ন, মানসম্পন্ন কাজ নিশ্চিত করা ও আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে।

শ্রমিক অধিকার রক্ষা এবং ইউনিয়ন করার আইন প্রণয়ন ও চর্চায় শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ৪১ শতাংশ দেশও পিছিয়েছে। তবে কিছু দেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া। ২০২২ সালের পর দেশটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) দুটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রমনীতি গ্রহণ করে এগিয়ে গেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি অত্যন্ত কম। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হলেও এই খাতের শ্রমিকরা যে মজুরি পান, তা তাঁদের দারিদ্র্যসীমার নিচে রাখছে। খাতটির উন্নতি সত্ত্বেও শ্রমিকদের শোভন জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেওয়া যায়নি। সেই সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনসহ শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকারও প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। ফলে অসমতা হ্রাসের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের সারিতে থাকা অপ্রত্যাশিত নয়, বরং দুঃখজনক।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২ সালের পর বিশ্বের যেসব দেশে করপোরেট আয়কর কমেছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে একটি। বাংলাদেশের সঙ্গে এ তালিকায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, পাকিস্তান, জাম্বিয়া ও তুরস্ক। তবে এ সময়ে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি, অর্থাৎ করপোরেট কর কমিয়ে ধনীদের সুবিধা দেওয়া হলেও, সাধারণ মানুষের জন্য ভ্যাট কমানো হয়নি। ভ্যাট ধনী ও গরিব সবাইকে একই হারে দিতে হয়, যা পরোক্ষ কর হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই পরোক্ষ কর থেকে আসে, যার অর্থ হলো, অবস্থাপন্ন মানুষের থেকে প্রত্যক্ষভাবে কর আদায় করার যে নীতি থাকা উচিত, তা বাংলাদেশে কার্যকরভাবে নেই।

অক্সফামের প্রতিবেদনে তিনটি প্রধান সূচকের ভিত্তিতে সিআরআই সূচক তৈরি করা হয়েছে: সরকারি সেবা, করনীতি এবং শ্রম। এই তিন ক্ষেত্রের মধ্যে সরকারি সেবায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫তম, কর নীতিতে ৭১তম এবং শ্রমে ১১৮তম। ২০২৪ সালের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান ১২৭তম, পাকিস্তানের ১৪১তম, মালদ্বীপের ৬৬তম, নেপালের ১১৫তম এবং শ্রীলঙ্কার ১১৮তম।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রশংসিত হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, এবং কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। মানব উন্নয়ন সূচকেও অগ্রগতি হয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এই প্রবৃদ্ধির পেছনে একটি অন্ধকার দিক হলো ধনী-গরিবের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে, আয়ের জিনি সহগ (আয় বৈষম্যের জনপ্রিয় পরিমাপ) ২০০০ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৫০, যা ২০২২ সালে বেড়ে শূন্য দশমিক ৪৯৯ হয়েছে। সম্পদের বৈষম্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ।

এ বিষয়ে অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন যে অসমতা বাড়ছে। তবে অসমতা প্রতিরোধে নেওয়া পদক্ষেপগুলো খুবই দুর্বল। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাও যথেষ্ট নয়, এবং ধনীদের ওপর প্রগ্রেসিভ কর আরোপ করা হয় না। ধনীদের কর ফাঁকির সুযোগ থাকলেও দরিদ্রদের তা নেই, কারণ তাদের বিভিন্ন ধরনের পরোক্ষ কর দিতেই হয়।

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর