চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলারের বিরুদ্ধে ইতিহাসের অন্যতম বড় দরপতন লক্ষ্য করা গেছে।
মুদ্রার তুলনায় ডলারের মান কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। এ ধরনের বিপর্যয় সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৭৩ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্র স্বর্ণমান (Gold Standard) থেকে সরে আসে।
তবে এবারের প্রেক্ষাপট ৭০-এর দশকের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। অর্থনীতিবিদদের মতে, ডলারের এই পতনের পেছনে মূলত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এককেন্দ্রিক ও আগ্রাসী অর্থনৈতিক নীতিই বড় কারণ। বিশেষ করে বাণিজ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ, বৈদেশিক নীতিতে একচেটিয়াত্ব, এবং লাগামহীন সরকারি ব্যয় ও ঋণ—এই তিনটি বিষয় ডলারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ও বৈশ্বিক নেতৃত্ব নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকারি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
ডলারের এই দুর্বলতা সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের জন্য বিদেশ ভ্রমণ ব্যয়বহুল করে তুলেছে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও হ্রাস পাচ্ছে এমন সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ব্যাপকভাবে ঋণগ্রস্ত।
তবে দুর্বল ডলার কিছু ইতিবাচক প্রভাবও ফেলছে। রপ্তানির দিক থেকে মার্কিন পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে, কারণ ডলার সস্তা হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য তুলনামূলক কম দামে কিনতে পারছেন। তবে আমদানির ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাপ থেকেই যাচ্ছে।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন কিছু নীতিগত নমনীয়তা দেখাতে শুরু করেছে, তবুও ডলারের পতন থামছে না। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার ও বন্ডবাজারে কিছুটা ইতিবাচক গতি লক্ষ্য করা গেছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা গবেষক স্টিভ ইংল্যান্ডার বলেন, “ডলার শক্তিশালী কি না, সেটিই আসল প্রশ্ন নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো—বিশ্ব অর্থনীতি ডলারের ভূমিকাকে এখন কেমনভাবে মূল্যায়ন করছে।”
ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর বিনিয়োগকারীরা ধারণা করেছিলেন, তার সরকার ব্যবসাবান্ধব নীতির মাধ্যমে বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, শুল্কনীতি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শপথ গ্রহণের সময় ডলার সূচক সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছলেও, এরপর থেকেই তার অবনমন শুরু হয়। মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ সুদের হার নিয়ে শঙ্কা বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করে তোলে।
চূড়ান্ত ধাক্কা আসে ২ এপ্রিল, যখন ট্রাম্প এক ঘোষণায় একাধিক দেশের ওপর আকস্মিকভাবে উচ্চ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেন। এ ঘোষণার পরপরই শেয়ারবাজার, বন্ড ও ডলারের বাজারে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সংকট কেবল ডলারের দরপতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নেতৃত্ব, আর্থিক নীতিমালা এবং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ওপর গভীর প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। অনেকের ধারণা, এটি হয়তো সাময়িক নয় বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
এসআর
মন্তব্য করুন: