[email protected] শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা: কর্মক্ষেত্রে সচেতনতার ঘাটতি বাড়াচ্ছে ঝুঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৪ নভেম্বর ২০২৫ ১২:৪১ পিএম

সংগৃহীত ছবি

রাজধানীর আফতাবনগরের বাসিন্দা ইফতেখার আহমেদ (৪২) সম্প্রতি শারীরিক জটিলতার কারণে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন।

গুলশান–২-এর একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইফতেখার দীর্ঘদিনের উপসর্গ উপেক্ষা করে হঠাৎ উচ্চ রক্তচাপ অনুভব করলে স্থানীয় ক্লিনিকে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস। ছয় মাস ধরে বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। নিয়ম মেনে চলার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে ইফতেখার বলেন, “আগের চেয়ে ভালো আছি, তবে নিয়ম ভাঙলে বিপদ হতে পারে।”

লালবাগের সামিয়া হকও একই অভিজ্ঞতার কথা জানান। অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সামিয়া কিডনি জটিলতা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে পরীক্ষায় ধরা পড়ে তার ডায়াবেটিস। চিকিৎসকদের মতে, তার কিডনি সমস্যা মূলত অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসেরই প্রভাব।

এই দুটি ঘটনা আলাদা হলেও দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি একই—প্রায় প্রতিটি পরিবারেই একজন না একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত বা উচ্চঝুঁকিতে রয়েছেন। ভয়াবহ বিষয় হলো, আক্রান্তদের অর্ধেকই জানেন না যে তারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তাই এ রোগকে বলা হয় ‘নীরব ঘাতক’।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) ডায়াবেটিস অ্যাটলাস ২০২৫–এর তথ্য বলছে, রোগীর সংখ্যায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সপ্তম। দেশে এক কোটি ৩৮ লাখের বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর অর্ধেকের চিকিৎসা হচ্ছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস)-এর আওতায়।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, ডায়াবেটিস কেবল ব্যক্তির স্বাস্থ্যে নয়, দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘসময় বসে কাজ করা, মানসিক চাপ, কম শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদি আধুনিক কর্মস্থলের পরিবেশ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম এবং সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস. মুরশিদ কর্মক্ষেত্রে ডায়াবেটিস প্রতিরোধের গুরুত্ব তুলে ধরে বার্তা দিয়েছেন।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রভিত্তিক সচেতনতা এখনো দুর্বল। অথচ সময়মতো প্রতিরোধে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।

১. বছরে অন্তত একবার রক্তে শর্করা, রক্তচাপ ও বিএমআই পরীক্ষা
২. অফিস ক্যান্টিনে স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করা ও চা–কফির চিনির ব্যবহার কমানো
৩. মানসিক চাপ কমাতে কাউন্সেলিং ও বিশ্রামের ব্যবস্থা
৪. লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহারের উৎসাহ এবং বিরতিতে হাঁটার অভ্যাস
৫. ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বিষয়ে প্রশিক্ষণের আয়োজন

অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, মানসিক চাপ, অনিয়মিত জীবনধারা ও ব্যায়ামের অভাব ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি বিকল, অন্ধত্ব এমনকি অঙ্গচ্ছেদের মতো ভয়াবহ জটিলতায়ও রূপ নিতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, সুশৃঙ্খল জীবন, নিয়মিত ওষুধ ও ইনসুলিন গ্রহণ এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

আইডিএফ জানায়, বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৫৯ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যার ৭০ শতাংশই প্রতিরোধযোগ্য। এখনই উদ্যোগ না নিলে ২০৫০ সালে এ সংখ্যা ৮৫ কোটিতে পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশে আক্রান্তদের অর্ধেকই নারী। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের ৬৫ শতাংশ পরবর্তীতে টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন—ঝুঁকি বাড়ে তাদের সন্তানেরও।

১. ৮০% রোগী শনাক্ত করা
২. ৮০% রোগীর রক্তশর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা
৩. ৮০% রোগীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
৪. ৬০% চল্লিশোর্ধ্ব রোগীকে স্টাটিন সুবিধা প্রদান
৫. সকল টাইপ–১ রোগীর জন্য ইনসুলিন শতভাগ সহজপ্রাপ্য করা

জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, “অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও পরিবর্তিত জীবনধারা ডায়াবেটিস বাড়াচ্ছে। কর্মস্থলে সচেতনতা তৈরি হলে রোগ প্রতিরোধ আরও সহজ হবে।”
বাডাসের মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনের মতে, “ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপী মহামারি রূপ নিয়েছে। আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।”

২০০৭ সাল থেকে জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হচ্ছে ১৪ নভেম্বর। এ উপলক্ষে বারডেমে গতকাল বাডাস সংবাদ সম্মেলন করে। আজ রোডশো, রক্তদান, হ্রাসকৃত মূল্যে হার্ট ক্যাম্প এবং আগামীকাল বিনামূল্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা, প্রশ্নোত্তর ও আলোচনা সভার আয়োজন রয়েছে।

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর