এইডস (AIDS), যার পুরো নাম অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিন্ড্রোম, একটি মারণব্যাধি যা হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (HIV) দ্বারা সৃষ্ট।
এটি মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে, ফলে সহজেই অন্যান্য রোগ শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। এইডস গত কয়েক দশকে লাখো মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
HIV প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৮১ সালে। প্রাথমিকভাবে এটি শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায় বলে মনে করা হলেও, পরে এটি প্রমাণিত হয় যে এটি যে কারও মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এইডস বিশ্বজুড়ে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বিজ্ঞানীরা এর চিকিৎসার জন্য নানা ধরণের গবেষণা শুরু করেন।
অনেকেই মনে করেন HIV এবং এইডস একই জিনিস, তবে তা নয়।
১. HIV: এটি একটি ভাইরাস যা সংক্রমণের পর শরীরে ইমিউন সিস্টেম ধ্বংস করতে শুরু করে।
২. এইডস: এটি HIV সংক্রমণের চূড়ান্ত ধাপ, যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরোপুরি দুর্বল হয়ে পড়ে।
প্রত্যেক HIV পজিটিভ রোগী এইডস রোগী নয়, তবে সঠিক চিকিৎসা না হলে HIV সংক্রমণ পরবর্তীতে এইডসে রূপ নিতে পারে।
এইডস কিভাবে ছড়ায়?
এইডস প্রধানত শরীরের তরলের মাধ্যমে ছড়ায়। সংক্রমণের প্রধান পথগুলো হলো:
১. অরক্ষিত যৌন সম্পর্ক: সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে সুরক্ষা ছাড়াই যৌন সম্পর্ক স্থাপন।
২. সংক্রমিত রক্তের ব্যবহার: পরীক্ষা না করা রক্ত গ্রহণ।
৩. মা থেকে শিশুর মধ্যে সংক্রমণ: গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে বা স্তন্যপানের মাধ্যমে।
৪. সংক্রমিত সূঁচ বা সিরিঞ্জের ব্যবহার: সাধারণত মাদক সেবনকারীদের মধ্যে এটির মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটে।
৫. আঘাতের মাধ্যমে সংক্রমণ: বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ পথ।
লক্ষণসমূহঃ
HIV সংক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণগুলো অনেক সময় শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে। এটি শরীরে প্রবেশ করার পর ধীরে ধীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে। লক্ষণগুলো তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত:
১. প্রাথমিক পর্যায় (Acute Stage)
এই সময় সাধারণত সর্দি-জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা যায়:
•জ্বর
•গলা ব্যথা
•মাথাব্যথা
•গায়ে ব্যথা
•লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া
২. নীরব পর্যায় (Latent Stage)
এই সময় সংক্রমণ শরীরে সক্রিয় থাকে কিন্তু কোনো বড় লক্ষণ দেখা যায় না। এই পর্যায় কয়েক বছর স্থায়ী হতে পারে।
৩. এইডস পর্যায় (AIDS Stage)
•দ্রুত ওজন কমে যাওয়া
•দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া
•নিউমোনিয়া ও অন্যান্য সংক্রমণ
•চামড়ায় দাগ বা ক্ষত
•স্মৃতিভ্রংশ বা স্নায়বিক সমস্যা
কিছু বিশেষ জনগোষ্ঠী এইডসের ঝুঁকিতে বেশি থাকে:
১. মাদক সেবনকারীরা (যারা একই সূঁচ ব্যবহার করে)।
২. যৌনকর্মী এবং তাদের ক্লায়েন্ট।
৩. একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে অরক্ষিত যৌন সম্পর্ক স্থাপনকারীরা।
৪. সংক্রমিত মায়ের সন্তান।
৫. স্বাস্থ্যকর্মীরা, বিশেষ করে যারা সংক্রমিত রক্ত বা সূঁচ নিয়ে কাজ করেন।
এইডস প্রতিরোধঃ
এইডস প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কিছু কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা উল্লেখ করা হলো:
১. সুরক্ষিত যৌন সম্পর্ক স্থাপন: যৌন সম্পর্কে সর্বদা কনডম ব্যবহার করা উচিত।
২. রক্ত পরীক্ষা করা: রক্ত গ্রহণের আগে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে এটি HIV মুক্ত।
৩. সুরক্ষিত সূঁচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার: একবার ব্যবহৃত সূঁচ বা সিরিঞ্জ পুনরায় ব্যবহার করা উচিত নয়।
৪. HIV পজিটিভ মা-বাবার সচেতনতা: গর্ভধারণের আগে এবং পরে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা।
৫. HIV পরীক্ষা: নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সংক্রমণ শনাক্ত করা।
এইডসের এখনো কোনো স্থায়ী নিরাময় নেই। তবে, অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (ART) নামে একটি চিকিৎসা রয়েছে যা রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে।
ART কীভাবে কাজ করে:
•ভাইরাসের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
•রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
•অন্যান্য সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে রোগীরা দীর্ঘ সময় সুস্থ জীবনযাপন করতে পারেন।
তাছাড়া এইডস নিয়ে সমাজে প্রচুর ভুল ধারণা এবং কুসংস্কার রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
•অনেকেই মনে করেন এটি শুধুমাত্র যৌনকর্মীদের রোগ।
•কারো সঙ্গে খাওয়া বা বসবাস করলেও এইডস ছড়ায়—যা সম্পূর্ণ ভুল।
•HIV পজিটিভ রোগীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
এধরনের কুসংস্কার দূর করতে শিক্ষামূলক প্রচারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কয়েক কোটি মানুষ HIV সংক্রমণে আক্রান্ত। জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী:
•প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন।
•উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এইডস সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে।
•সচেতনতার অভাব, দরিদ্র স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এবং সামাজিক কুসংস্কার এর জন্য দায়ী।
এইডস একটি প্রাণঘাতী রোগ হলেও সচেতনতা, চিকিৎসা ও সহযোগিতার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রতিটি মানুষের উচিত এইডস সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করা। একসঙ্গে কাজ করলে একদিন এইডস মুক্ত বিশ্ব গড়া সম্ভব।
এসআর
মন্তব্য করুন: