[email protected] শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫
২৩ কার্তিক ১৪৩২

চীনের বাজারে ‘বিস্ময়কর’ ব্যর্থতা বাংলাদেশের, কারণ কী?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৬ নভেম্বর ২০২৫ ৮:৪৮ পিএম

প্রায় ১৪১ কোটি মানুষের দেশ চীন—রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার।

বাংলাদেশও এই বাজারে ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। কিন্তু এত বড় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও চীনের বাজার দখলে নিতে পারছে না বাংলাদেশ। অথচ একই সুবিধা কাজে লাগিয়ে দারুণভাবে রপ্তানি বাড়িয়েছে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া।

চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের অর্ধশতক পেরিয়ে গেছে। তবু এখনো পর্যন্ত কোনো অর্থবছরেই এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি রপ্তানি করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এত বড় বাজার ও শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকার পরও রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়া সত্যিই বিস্ময়কর।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীন থেকে প্রায় ২ হাজার ৪২৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যেখানে রপ্তানি ছিল মাত্র ৭৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ আমদানির পরিমাণ রপ্তানির তুলনায় প্রায় ৩২ গুণ বেশি।

গত এক দশকে দুই দেশের বাণিজ্য তিন গুণ বেড়েছে, কিন্তু রপ্তানি সে হারে বাড়েনি। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে, অথচ মোট রপ্তানির মাত্র দেড় শতাংশ যায় সে দেশে।

২০২২ সালে চীন বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ পণ্য শুল্কমুক্তভাবে গ্রহণের অনুমতি দেয়। তবুও রপ্তানি বাড়ার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। এনবিআর ও ইপিবির পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি হয়েছিল প্রায় ২ হাজার ১১২ কোটি ডলার, আর রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ৬৮ কোটি ডলার।

রপ্তানি ব্যর্থতার কারণ

বাংলাদেশ মূলত তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য (যেমন আম, কাঁঠাল), কাঁকড়া, কুঁচিয়া ও পাটজাত পণ্য চীনে রপ্তানি করে থাকে। কিন্তু এসব পণ্যের মান, চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ঘাটতি থাকার কারণে রপ্তানি স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন বিশ্বে তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ। তাই একই পণ্যে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, শুধু শুল্কমুক্ত সুবিধা যথেষ্ট নয়—চীনের বাজার ধরতে হলে তাদের চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পিত উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাঁর ভাষায়,

> “চীন বছরে প্রায় তিন হাজার বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। আমাদের উচিত সেই বাজারে চাহিদাসম্পন্ন পণ্য তৈরি করা। শুল্কমুক্ত সুযোগ কাজে লাগাতে হলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।”

 

তিনি আরও বলেন,

> “আমদানি নিজেই খারাপ নয়, কিন্তু রপ্তানি না বাড়লে অর্থনীতি ভারসাম্য হারায়। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।”


চীনে রপ্তানি বাড়ানোর সম্ভাব্য কৌশল

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, চীন প্রায় সব ধরনের পণ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর, তাই সেখানে রপ্তানি করা সহজ নয়। তাঁর মতে,

> “রপ্তানি বাড়াতে আমাদের কৌশলী হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পোশাক (যেমন ডেনিম, লিভাইস) আমরা যদি ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগে চীনে বিক্রি শুরু করি, তবে একসময় চীনারা আমাদের কাছ থেকেই সেই পণ্য কম দামে কিনবে। এতে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে বড় রপ্তানি বিপ্লব ঘটতে পারে।”


তিনি আরও যোগ করেন,

> “প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, দক্ষ কর্মী এবং প্রত্যাশিত চীনা বিনিয়োগের ঘাটতি রপ্তানি বৃদ্ধির পথে প্রধান বাধা।”

বাংলাদেশের বাজারে চীনা পণ্যের প্রভাব

বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, একসময় ভারত ছিল বাংলাদেশের প্রধান আমদানির উৎস। তবে ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে সেই স্থান দখল করে নেয় চীন। এখন চীনই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ।

পরিসংখ্যান বলছে—

১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে চীন থেকে এসেছে মাত্র ১১ কোটি ডলারের পণ্য।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ২০৮ কোটি ডলার।

২০০৯-১০ অর্থবছরে আমদানি দাঁড়ায় ৩৮২ কোটি ডলার।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসে তা পৌঁছায় ১ হাজার ৫৫৮ কোটি ডলারের ঘরে।


এভাবে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে চীনা পণ্যের দাপট, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলছে।


চীনের বাজারে প্রবেশ কেবল শুল্ক সুবিধা দিয়ে সম্ভব নয়। প্রয়োজন মানসম্পন্ন পণ্য, বাজার গবেষণা, কৌশলগত বিনিয়োগ এবং দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন। ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো উদাহরণ দেখায়—সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করলে চীনের মতো বিশাল বাজারও বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত হতে পারে।

 

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর