[email protected] রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
১৫ আষাঢ় ১৪৩২

একচেটিয়া সংসদ নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিনিধিত্ব দরকার- পিআর পদ্ধতি কি সময়ের দাবি?

সাইদুর রহমান

প্রকাশিত: ২৯ জুন ২০২৫ ৯:২০ এএম

বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক আলোচনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা (Proportional Representation - PR)। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রয়েছে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (FPTP) বা সংখ্যাগরিষ্ঠভিত্তিক একক আসনের নির্বাচন পদ্ধতি।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক বৈচিত্র্য, সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্তি এবং জাতীয় প্রতিনিধিত্বে ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা জোরালো হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন


পিআর পদ্ধতিতে একটি দল যে পরিমাণ ভোট পায়, সে অনুপাতে সংসদে আসন পায়। এর ফলে সংসদে ক্ষুদ্র দলগুলোর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হয় এবং কোনো একক দলের অতিরিক্ত আধিপত্য ঠেকানো সম্ভব হয়। নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, সুইডেনসহ অনেক দেশে এই পদ্ধতি সফলভাবে কার্যকর রয়েছে।


বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০০টি সংসদীয় আসনে সরাসরি ভোট হয়। যেখানে একটি আসনে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থীই জয়ী হন এবং অন্য সব প্রার্থীর ভোট কার্যত মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এতে একটি দল কম ভোট পেয়েও বিপুল সংখ্যক আসন পেয়ে যায়, যা সংসদে প্রকৃত জনমতের প্রতিফলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।


নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ: ভোট বনাম আসনের বৈষম্য

বিগত জাতীয় নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, ভোট ও আসনের মধ্যে ভারসাম্য নেই।

• ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদে
• বিএনপি পেয়েছিল ৪০.৯৭% ভোট, কিন্তু আসন পেয়েছিল ১৯৩টি
• আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.১৩% ভোট, কিন্তু আসন পেয়েছিল মাত্র ৬৬টি
• আনুপাতিক হারে হলে: বিএনপি ১২৩টি, আওয়ামী লীগ ১২০টি আসন পেত

• ২০০৮ সালের ৯ম সংসদে
• আওয়ামী লীগ ৪৯% ভোটে পেয়েছিল ২৩০টি আসন
• বিএনপি ৩৩.২০% ভোটে পেয়েছিল মাত্র ৩০টি আসন
• পিআর হিসাব অনুযায়ী: আওয়ামী লীগ ১৪৭টি, বিএনপি ১০০টি আসন পেত

• ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়—ভোট প্রায় সমান হলেও আসনের হিসাব একতরফা হয়

এ ধরণের ব্যবস্থায় সংসদে কার্যকর বিরোধী দল গড়ে ওঠে না এবং একচেটিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়।


পিআর পদ্ধতির প্রধান সুবিধা হলো—ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে ভারসাম্য আসে। ক্ষুদ্র দলগুলোর কণ্ঠও সংসদে উঠে আসে, ফলে গণতন্ত্র আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়।

তবে বাস্তবতার জায়গায় কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন—কোন প্রার্থী কোন আসনের প্রতিনিধি হবেন, তা নির্ধারণে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর সমাধান হিসেবে দলীয় তালিকা ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে, যেখানে দল নির্বাচনের আগে একটি তালিকা জমা দেয় এবং ভোটের ভিত্তিতে সেই তালিকা অনুযায়ী আসন বণ্টন হয়।

এছাড়া এই পদ্ধতি চালু করতে হলে সংবিধানে সংশোধন প্রয়োজন হবে, যা একটি বড় রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া সম্ভব নয়। বর্তমান ব্যবস্থায় বৃহৎ দলগুলো সুবিধাভোগী হওয়ায় তারা এই সংস্কারের প্রতি উদাসীন। তদুপরি, ভোটারদের কাছে নতুন এই পদ্ধতি বোঝাতে সময় ও সচেতনতা দরকার।


বাংলাদেশে সংসদীয় প্রতিনিধিত্বে ভারসাম্যহীনতা একটি দীর্ঘদিনের বাস্তবতা। ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব না পাওয়ায় বহু ভোটার কার্যত অপ্রতিনিধিত্বশীল থেকে যান। এই প্রেক্ষাপটে পিআর বা অন্তত মিশ্র পদ্ধতির গুরুত্ব বাড়ছে। এটি শুধু একটি নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন নয়, বরং গণতন্ত্রকে আরও সহনশীল, প্রতিনিধিত্বমূলক ও অংশগ্রহণমূলক করার পথে একটি সম্ভাব্য পদক্ষেপ।

বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালুর বিষয়ে এখনো রাজনৈতিক ঐক্যমত গড়ে ওঠেনি। তবে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক একচেটিয়াতা ও প্রতিনিধিত্বের সংকটে, এই পদ্ধতির সম্ভাবনা নিয়ে জাতীয়ভাবে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর