আগামীর বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটি কোনো একক রাষ্ট্রের বা নির্দিষ্ট অঞ্চলের সমস্যা নয়; বরং এটি বৈশ্বিক সংকট।
তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত কাঠামো কনভেনশনের (ইউনএফসিসিসি) আওতায় ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর Conference of Parties (COP) অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবছর, COP-29 আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অংশগ্রহণ করেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
জলবায়ু বলতে কোনো অঞ্চলের বহু বছরের আবহাওয়ার গড় বৈশিষ্ট্যকে বোঝায়। যখন এই স্বাভাবিক ধরণে দীর্ঘমেয়াদে পরিবর্তন আসে, তখন তা জলবায়ু পরিবর্তন হিসেবে পরিচিত। যদিও এটি একটি ধীর প্রক্রিয়া, এর প্রভাব চরম ও সুদূরপ্রসারী। এর ফলে দেখা দিচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, চরম আবহাওয়া, বন্যা, নদীভাঙন, খরা, দাবানল, বনভূমি সংকোচন, বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং মরুভূমি সৃষ্টি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হিসেবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ থেকে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দায়ী। নাসার জিআইএসএসের তথ্যমতে, ১৮৮০ সালের পর থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, বিশেষত ১৯৭৫ সালের পর। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, নইলে বিপর্যয় অনিবার্য।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক প্রচেষ্টা
২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ অর্ধেকে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবপ্রবণ দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তার জন্য ২০০৯ সালের কপ-১৫ সম্মেলনে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রস্তাব করা হয়।
পরবর্তী সম্মেলনগুলোতেও এই সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কপ-২৬-এ আর্থিক সহায়তার বিষয়টি গুরুত্ব পায়, আর কপ-২৭-এ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০২৩ সালের কপ-২৮-এ এই ফান্ডে ৭০০ মিলিয়ন ডলার অনুদানের অঙ্গীকার করা হলেও শিল্পোন্নত দেশগুলোর অনীহা এবং মানবিক সদিচ্ছার অভাবে এর বাস্তবায়ন এখনও বাধাগ্রস্ত।
কপ-২৯: নতুন উদ্যোগ ও চ্যালেঞ্জ
বাকুতে অনুষ্ঠিত কপ-২৯ সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। এখানে ২০৩৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা এক ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার প্রস্তাব আনা হয়েছে। তবে সম্মেলনটি এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা সম্মেলনে অনুপস্থিত থাকায় বৈশ্বিক ঐক্যের অভাব স্পষ্ট হয়েছে।
এমতাবস্থায়, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
এবারের কপ-২৯ সম্মেলনে বাংলাদেশ এক ভিন্ন বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর জেলা ভয়াবহ আকস্মিক বন্যার কবলে পড়ে। পাশাপাশি, কয়েক বছর ধরে দেশ দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড় এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অন্যান্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবের ঝুঁকিতে রয়েছে।
২০২৩ সালের জুন থেকে এ পর্যন্ত দেশে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ ০.৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে আগামী ৫০ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে সুন্দরবন সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোর শুকনো মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাওয়া এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটছে।
সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান
কপ-২৯ সম্মেলনে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উদ্বেগ ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা। ঝুঁকিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বরাদ্দকৃত আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য বিশেষভাবে সোচ্চার ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্মেলনে শিল্পোন্নত দেশগুলোর উদাসীনতা এবং আর্থিক সহায়তার বিষয়ে দর-কষাকষির মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেন।
তিনি তার “বিগ থ্রি জিরো” ধারণা তুলে ধরেন, যা মানবসভ্যতা রক্ষায় একটি টেকসই পথনির্দেশনা হিসেবে কাজ করতে পারে। এই তত্ত্বের মূল তিনটি স্তম্ভ হলো:
1.শূন্য কার্বন নিঃসরণ: গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ করা।
2.শূন্য সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ: সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন নিশ্চিত করা।
3.শূন্য বেকারত্ব: প্রতিটি মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানান, এই তত্ত্বের মাধ্যমে একটি পরিবেশবান্ধব এবং মানবিক জীবনধারা গড়ে তোলার।
সম্ভাব্য পদক্ষেপ
কপ-২৯ সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত সহায়তা নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হবে, যেমন:
•বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণ।
•খরা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন।
•নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা।
•বনভূমির বিস্তার ও উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজ বেষ্টনী তৈরি।
•উপকূলীয় মানুষের পুনর্বাসন ও জীবনমান উন্নয়ন।
•কার্বন নিঃসরণ হ্রাস এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি।
সম্মেলনের গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সংকট হওয়ায় শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। প্রতিটি দেশের সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বনেতাদের শুধু চুক্তি স্বাক্ষরে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবায়নের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলন তখনই সফল হবে, যখন গ্রহণকৃত পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হবে। তবেই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর জন্য নির্মল ও বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এসআর
মন্তব্য করুন: