বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি ম্যুরাল, ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি স্থাপন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
টানা ১৫ বছর ধরে ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও প্রতিকৃতি তৈরির ক্ষেত্রে এই সরকার উৎসাহ দেখিয়েছিল, যেখানে স্থানীয় প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক সংস্থাও নিজ উদ্যোগে এগুলো নির্মাণ করেছিল।
এই বিপুল সংখ্যক ভাস্কর্য ও ম্যুরাল স্থাপনে সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বর্তমানে এসব ব্যয় অপ্রয়োজনীয় হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বড় আকারের ভাস্কর্য ও ম্যুরালগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। যেগুলো ভাঙা সম্ভব হয়নি, সেগুলোকে বিকৃত করা হয়েছে কালি লেপে। অনেক স্থানে ভাস্কর্যগুলো এমনভাবে সংস্কার করা হয়েছে, যাতে বোঝার উপায় নেই যে সেখানে এসব স্থাপনা ছিল।
সূত্র জানায়, ২০২১ সালে পুলিশের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছিল, যেখানে বলা হয়, দেশে বঙ্গবন্ধুর ১,২২০টি ভাস্কর্য ও ম্যুরাল রয়েছে। খুলনা বিভাগে ২১টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১২টি, ঢাকা বিভাগে ৪১টি, বরিশাল বিভাগে ৩টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫টি, রংপুর বিভাগে ৪টি, রাজশাহী বিভাগে ৯টি এবং সিলেট বিভাগে ১টি উল্লেখযোগ্য স্থানে স্থাপিত হয়। এর বাইরেও আরও কয়েক হাজার ভাস্কর্য ও ম্যুরাল নির্মিত হয়েছে।
শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নয়, তাঁর স্বজন ও বইয়েরও ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পাড়ে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। দেশের আট বিভাগের প্রতিটি সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়নে ভাস্কর্য স্থাপনের নির্দেশ ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এ কাজে কারিগরি সহায়তা করেছে, যদিও কোনো পৃথক প্রকল্প নেওয়া হয়নি।
সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। প্রাইমারি স্কুলের উন্নয়ন তহবিল থেকেও এই কাজে ব্যয় করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ৩২টি বোর্ড ও দপ্তরে ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। মন্ত্রণালয়গুলোর অধীনে ৭০০ দপ্তরের অধিকাংশেই ম্যুরাল ছিল, যেগুলো তৈরিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে।
সড়কের শুরু ও শেষ, নদীর তীর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনা—এমন অনেক স্থানে ভাস্কর্য ও ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ম্যুরাল নির্মাণে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। রাজধানীর পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধুর ৭১ ফুট উচ্চতার ভাস্কর্যসহ ‘বঙ্গবন্ধু চত্বর’ তৈরিতে বরাদ্দ ছিল ৫৫ কোটি টাকা। দোলাইরপাড়ে চীন থেকে তৈরি ভাস্কর্য আনা হলেও ইসলামী দলগুলোর আপত্তির কারণে সেটি স্থাপন করা যায়নি।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধে ১৫ ফুট উচ্চতার ভাস্কর্য নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড, যা তৈরিতে খরচ হয় ২৩ লাখ টাকারও বেশি। দেশের প্রতিটি জেলা পরিষদে ম্যুরাল স্থাপন করা হয়, যার মধ্যে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদে এক কোটি সাত লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ম্যুরাল নির্মিত হয়। ২০১২ সালে ১,০৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে খুলনা সিটি করপোরেশন খুলনা নগর ভবনে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ম্যুরাল নির্মাণ করে। রাজশাহীতে নগরীর সিঅ্যান্ডবি এলাকায় ২ কোটি ২ লাখ টাকা খরচে আরেকটি ম্যুরাল তৈরি করা হয়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় একটি ম্যুরাল নির্মাণ করে, আর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন করে, যাতে খরচ হয় ৮২ লাখ টাকা। এছাড়া, “বজ্রকণ্ঠ” নামের ভাস্কর্যটি নির্মাণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ৮৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করে। এই ভাস্কর্যটির উচ্চতা সাড়ে ২২ ফুট, বেদিসহ মোট উচ্চতা ২৬ ফুট, যা সাদা সিমেন্টের ঢালাইয়ের মাধ্যমে তৈরি এবং ওজন প্রায় ৩০ টন।
দেশের প্রতিটি জেলা পরিষদেও বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। এসব ম্যুরালে ব্যয় হয়েছে ৮ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার বেশি। ময়মনসিংহ জেলা পরিষদে বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যুরাল নির্মাণে ১ কোটি ৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা খরচ হয়। বাগেরহাট জেলা পরিষদের সামনে একটি ম্যুরাল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। রংপুর জেলা পরিষদ ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ম্যুরাল স্থাপন করে, আর রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রায় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে শহরের উপজেলা পরিষদের সামনে বিশাল একটি ভাস্কর্য ও ম্যুরাল নির্মাণ করে। বগুড়া জেলা পরিষদ ১০ লাখ টাকায় একটি ম্যুরাল তৈরি করে, আর মানিকগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ঘিরে “বঙ্গবন্ধু চত্বর” নির্মাণ করা হয়, যার ব্যয় ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। যশোর শহরের বকুলতলায় যশোরের জেলা প্রশাসনের তহবিলে ৫৪ লাখ টাকা খরচে আরেকটি ম্যুরাল নির্মাণ করা হয়।
২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১,০৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকার বাজেটে দেশের আট বিভাগের ৬৩টি জেলার ৪৭০টি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন ও বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেয়, যা ২০১৫ সালের জুন নাগাদ সম্পন্ন হয়। প্রকল্প অনুযায়ী প্রতিটি কমপ্লেক্সের সামনে একটি ম্যুরাল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়, যেখানে প্রতিটি ম্যুরালের জন্য ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল।
এসআর
মন্তব্য করুন: