news.protidinerbangla22@gmail.com বৃহঃস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৪ আশ্বিন ১৪৩১

সংকট উত্তরণে প্রয়োজন সরকারের থোক বরাদ্দ

ফান্ড সংকটেই টাকা পাচ্ছেনা অবসরে যাওয়া শিক্ষক কর্মচারীরা

সাইদুর রহমান

প্রকাশিত: ১৫ জুলাই ২০২৪ ৮:০০ পিএম
আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৪ ১২:২০ পিএম

বিবি হালিমার কষ্টের কথা শুনছেন অবসরের সদস্য সচিব

অবসরে যাওয়া শিক্ষক কর্মচারীদের টাকা পেতে সময় লেগে যায় বছরের পর বছর।

* আবেদন জমা পড়ে আছে ৪০ হাজার!
* বকেয়া পরিশোধে দরকার সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা
* থোক বরাদ্দ ছাড়া সংকট কাটবে না
* কারিগরি কমিটি গঠন, তিন বছরের রোডম্যাপ
* বছরে চাহিদা ১৩শ কোটি, জমা হয় ৯শ কোটি টাকা
* টাকা পেতে পেতে মারাও যাচ্ছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা!
* শিক্ষক-কর্মচারীদের কষ্ট লাঘবে সম্মিলিতভাবে কাজ করছি: সদস্য সচিব


রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় মাইনীমুখ মডেল হাইস্কুলের শিক্ষক শাহ আলম অবসরে যান ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি । জীবিত থাকতে নিজেই ওই বছরের ৮ মে আবেদন জমা দেন তিনি। কিন্তু  অবসর সুবিধা পাওয়ার আগে গত বছরের ৬ জুন মারা যান শাহ আলম।

এদিকে স্বামীর মৃত্যুতে দুই অবুঝ সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন স্ত্রী বিবি হালিমা। কূল কিনারা না পেয়ে গত সপ্তাহে সন্তানদের নিয়ে অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিবের সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসেন হালিমা।

এ সময় সন্তানদের নিয়ে জীবন চালানোর কষ্টের কথা বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন এই নারী। যা ছুঁয়ে যায় সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদীসহ উপস্থিত অন্যরাও। পার্বত্য অঞ্চল থেকে আসা এই নারীর আর্থিক অনটন এতটাই প্রকট যে বাড়ি ফেরার গাড়ি ভাড়াও ছিল না। পরে তার দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেন অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব শরীফ সাদী। একইসঙ্গে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার স্বামীর টাকার ব্যবস্থা করার আশ্বাসও দেন তিনি।

কেবল বিবি হালিমাই নয় সারাদেশের প্রায় ৪০ হাজার আবেদন প্রত্যাশী ও তার স্বজনদের এমন আর্তনাদ প্রতিনিয়তই শুনতে পাওয়া যায় অবসর সুবিধা বোর্ড অফিসে।


রবিবার রাজধানীর ব্যানবেইসে অবস্থিত অবসর সুবিধা বোর্ডে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শত শত আবেদন প্রত্যাশীদের জটলা। এদের মধ্যে কেউ কেউ কিডনীসহ না জটিল রোগে আক্রান্ত। কেউ কেউ আবার এসেছেন তার মৃত বাবা মা কিংবা তার বড় ভাইয়ের টাকার আবেদন নিয়ে।


বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী প্রতিদিনের বাংলাকে বলেন, ফান্ডই মূল সংকট। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের দুর্ভোগ কষ্ট দূর করতে সম্মিলিতভাবে কাজ করছি। প্রতিদিন আমাকে সারাদেশ থেকে অবসরে যাওয়া শিক্ষক কর্মচারী কিংবা শুনতে হয় টাকা না পাওয়া মানুষগুলোর হয়রানির কথা।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে অবসর সুবিধা বোর্ডে অনিষ্পন্ন আবেদন রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার। এছাড়া গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ১ হাজার আবেদন জমা পড়ছেই। আর প্রতিমাসে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে ৬ শতাংশ হারে অবসর সুবিধা বোর্ডে জমা হয় মাত্র ৭৩ কোটি টাকা। এই হিসেবে বাতসরিক জমা হয় প্রায় ৯শ কোটি টাকা। তবে এর বিপরীতে বাতসরিক চাহিদা ১৩শ কোটি টাকারও বেশি। ফলে ঘাটতি থেকে যায় ৪৩২ কোটি টাকা। ফলে আবেদনকারীদের ঘুরতে হয় বছরের পর বছর। আর এর সমাধান করতে হলে প্রয়োজন সরকার থেকে থোক বরাদ্দ।


জানা গেছে, আবেদনকারীদের মধ্যে কেউ মারা গেলে, জটিল রোগে আক্রান্ত হলে কিংবা হজ্জ ওমরা প্রত্যাশীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টাকা প্রদান করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, ২৫ বছর এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক-কর্মচারী চাকরি থেকে অবসরে গেলে সর্বনিম্ন সাড়ে ৭ লাখ টাকা অবসর সুবিধা পান। আর একজন অধ্যক্ষ পান সর্বোচ্চ প্রায় ৫০ লাখ টাকা। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। জুলাই মাসের আবেদন নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াধীন।


তথ্যমতে, প্রতি মাসে অবসর সুবিধার জন্য গড়ে ৩ থেকে সাড়ে তিনশ আবেদন জমা হয়। ধারাবাহিকভাবে সেগুলো বোর্ডের পক্ষ থেকে নিষ্পত্তি করা হয়। এখন পর্যন্ত (২০২৪ সালের জুলাই) ৪০ হাজার আবেদনের বিপরীতে অবসর সুবিধা পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। সে হিসেবে গত চার বছরের অনিষ্পন্ন আবেদনের অনুকূলে আর্থিক সুবিধা দিতে হলে দরকার প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। অবসর সুবিধার টাকা ফেরতে ফান্ডই মূল সংকট। এ সংকট উত্তরনে প্রয়োজন সরকার থেকে থোক বরাদ্দ।


বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সবশেষ শিক্ষক-কর্মচারীদের ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি পাওয়ায় অবসরের টাকাও বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। একজন শিক্ষকের প্রতিটি ইনক্রিমেন্টের বিপরীতে অবসর ভাতায় দিতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর একজন শিক্ষক-কর্মচারী অন্তত সাতটি ইনক্রিমেন্ট পান চাকরিকালে। এই ইনক্রিমেন্টের কারণে তিনি অবসর ভাতায় ১৩ লাখ ৪ হাজার ১০০ টাকা বেশি পান।


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সরকারের কাছে শিক্ষক-কর্মচারীদের ভোগান্তি কমাতে এক হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ চেয়েছিল অবসর সুবিধা বোর্ড। কিš‘ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে মাত্র ৩শ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এই টাকা দিয়ে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন অবসর বোর্ডের কর্মকর্তারা।


জানা গেছে, শিক্ষকদের এই কষ্টের কথা নিয়ে খোদ সংসদেও কথা উঠেছে। সংসদ সদস্যরা দ্রুত শিক্ষকদের অবসরের টাকা পরিশোধের জন্য তাগাদা দিয়েছেন। অবশ্য সরকারও বসে নেই।
ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এ নিয়ে ১৬ সদস্যের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটি প্রাথমিকভাবে প্রথম বৈঠকে আগামী তিনবছরের মধ্যে শিক্ষক-কর্মচারীদের সকল পাওনা পরিশোধের রোডম্যাপ নির্ধারণ করেছেন। এই কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) মো. রবিউল ইসলাম।

২০০২ সালের ২৭ নং আইনের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড গঠন হয়। এ আইনের ধারা ১৫ তে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে প্রণীত প্রবিধান-২০০৫ অনুযায়ী ‘‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা’’ চালু হয়। এমপিওভূক্ত অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসরকালীন সময়ের সুবিধা প্রদান করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এবং কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এর অধীন এমপিওভূক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসর সুবিধা প্রদান কার্যক্রম এই বোর্ডের আওতাভূক্ত। এমপিওভূক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের এমপিও থেকে ৬ শতাংশ টাকা সঞ্চয় করে অবসর সুবিধাদি প্রদান করা হয়ে থাকে।


এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) রবিউল ইসলাম এ বিষয়ে প্রতিদিনের বাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি কাজ করছি। খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। কিভাবে শিক্ষক-কর্মচারীদের কষ্ট লাঘব করা যায় সেজন্য কাজ করছি।

এসআর

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর