দেশের রাজস্ব আয়ের প্রধান খাত মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট।
এই পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাইজেশনের অভাব এবং কার্যকর তদারকি না থাকায় ভ্যাট ফাঁকির সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এনবিআরের বিভিন্ন জরিপ ও ব্যবসায়ী সংগঠনের পর্যবেক্ষণেও একই চিত্র উঠে এসেছে।
বাণিজ্য মন্দার মধ্যেও নতুন ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের না করে হঠাৎ কর বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা এটিকে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হিসেবে দেখছেন।
ব্যবসায়ীদের মতে, করের হার না বাড়িয়ে বরং করজালের আওতা বাড়ানো হলে রাজস্ব আদায় বাড়তে পারত।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্রতি কয়েকটি পণ্যের ওপর ভ্যাট কমানোর ঘোষণা দিলেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সেটি যথেষ্ট নয়।
তারা দাবি করছেন, কর হার না বাড়িয়ে নতুন ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
ভ্যাট আদায়ে কারচুপি রোধে এনবিআর কয়েক বছর আগে অটোমেশন চালুর উদ্যোগ নিলেও সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। উল্টো, ম্যানুয়াল নিরীক্ষা প্রক্রিয়াও বন্ধ করে দেওয়ায় ফাঁকির ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
২০২১ সালে এনবিআরের ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও সাভারের ২৫টি মার্কেটে ১২ হাজার ৮৭১টি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দেয় না, যা মোট জরিপকৃত প্রতিষ্ঠানের ৮৮ শতাংশ।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'গত ছয় মাসে এনবিআর বড় কোনো অভিযান চালায়নি। ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠান শনাক্তে উদ্যোগী হলে রাজস্ব ঘাটতি অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হতো।'
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন আদালতে মামলায় আটকে থাকা ভ্যাটের পরিমাণ প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা।
এর মধ্যে হাইকোর্টে ২৮ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা এবং আপিল বিভাগে ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা আটকে আছে।
এছাড়া, বকেয়া ভ্যাটের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার বকেয়া ভ্যাট প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আলোচিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে সাত হাজার কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর, ফার্মাসিউটিক্যালস ও টোব্যাকো কোম্পানির বিরুদ্ধেও বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘ভ্যাট আদায়ের ফাঁকি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। করজাল বাড়ানোর পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে যে, ভোক্তাদের প্রদত্ত ভ্যাট সরকারী কোষাগারে জমা হচ্ছে।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, ‘কিছু প্রতিষ্ঠানের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপানোর পরিবর্তে এনবিআরের উচিত করজাল সম্প্রসারণ করা। এতে রাজস্ব আদায় বাড়বে এবং ভোক্তাদের ওপর চাপ কমবে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হলে কর হার বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না। এছাড়া, অটোমেশন নিশ্চিত করা গেলে ঘুষ ও অনিয়ম বন্ধ হবে এবং কর আদায় বৃদ্ধি পাবে।
তারা মনে করেন, কর নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবেই বর্তমান রাজস্ব ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে করজাল সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়াই হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
এসআর
মন্তব্য করুন: